(প্রথম ভাগ)
কিংবদন্তী অনুসারে, কোসেম সুলতান ১৫৮৯ সালে তিনোস দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন গ্রিক বংশোদ্ভুত এক ধর্মযাজকের মেয়ে। তার আসল নাম ছিল আনাস্তাসিয়া। মাত্র ১৫ বছর বয়সে বসনিয়ার কর্তৃপক্ষ তাকে দাসী হিসেবে ইস্তাম্বুলে পাঠান। তোপকাপি প্রাসাদের অসংখ্য দাসীর সঙ্গে হারেমে তার জায়গা হয়। পরবর্তীতে মুসলিম হওয়ার পর তার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ম্যাহপেকার, যার অর্থ, যে নারীর মুখ চাঁদের মতো। সেই সময় প্রথম আহমেদ উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। সুলতান প্রথম আহমেদ ম্যাহপেকারের রুপে গুণে মুগ্ধ হয়ে তাকে গ্রহণ করতে সম্মত হন। তারপর সুলতান আহমেদ তার নাম রাখেন কোসেম, যার অর্থ ভেড়ার পালের নেত্রী বা রাখাল।
কোসেমকে যখন সুলতান আহমেদের খাসদাসী হিসেবে নির্বাচন করা হয়, তারপর থেকেই তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়। কোসেম যখন খাসদাসী তখন হারেমের দায়িত্ব ছিল সুলতানের দাদী সাফিয়ে সুলতানের উপর। কিন্তু ১৬০৪ সালে সাফিয়ে সুলতান তার কর্তৃত্ব হারান। কিন্তু প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কারণেও তাকে এই পদ থেকে সরে আসতে হয়। ফলে তার বাকিটা জীবন প্রথামতে অন্য প্রাসাদে কাটাতে হয়। একই বছরে সুলতানের মা হানদান সুলতান ‘ভ্যালিদে সুলতান’ পদ লাভ করেন। তবে তার মৃত্যুর পর, কোসেম সুলতানের কাছে সুযোগ আসে হারেমের কর্তৃত্ব গ্রহণের। নিজের রুপ ও গুণ দিয়ে সুলতানের খাসদাসী থেকে প্রিয়তম স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি পান। হাসেকি সুলতান হিসেবে সমাদৃত হন। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন হারেমের অন্যতম প্রভাবশালী নারী। তিনি ১৬১৭ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ সুলতান প্রথম আহমেদ যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন পর্যন্ত ওই পদে আসীন ছিলেন।
তবে, সুলতান আহমেদের মৃত্যুর পর কোসেম সুলতান তোপকাপি প্রাসাদে তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন এবং তাকে তোপকাপি প্রাসাদ থেকে ইস্কি সারাহ প্রাসাদে থাকতে বাধ্য করা হয়। সুলতান মারা যাওয়ার পর তার পুত্রকে না বসিয়ে তার ভাই প্রথম মুস্তফাকে সিংহাসনে বসানো হয়। তিনি ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন। ফলে খুব দ্রুত তাকে সরিয়ে প্রথম আহমেদের আরেক স্ত্রী মাহফিরোজের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিতীয় ওসমানকে সিংহাসনে বসানো হয়। এতে কোসেম ক্ষুব্ধ হন। ফলে শুরু হয় সিংহাসন দখলের কোন্দল। যেহেতু কোসেম সুলতানের পুত্রদের মধ্যে কাউকেই সিংহাসনে বসতে দেওয়া হয়নি, সেহেতু তাকে জৌলুসবিহীন প্রাসাদে থাকতে দেওয়া হয়। এতে কোসেম ক্ষুব্ধ হন। কোসেম শুধুমাত্র একজন বিধবা রাজনারী হয়ে জীবন অতিবাহিত করতে চাননি। স্বামীর মৃত্যুর পর নিজের ও তার সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ঘুরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন।
রাজনীতির খেলায় কোসেম সুলতান ফিরে আসেন ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে। এবার তিনি আগের চেয়ে আরো বেশি সুচতুরতার প্রমাণ দেন। ধারণা করা হয়, কোসেম সুলতান হালিমে সুলতানের (প্রথম মুস্তফার মাতা) সাথে যোগসাজশ করে সুলতান দ্বিতীয় ওসমানকে জেনিসারি বাহিনী দ্বারা সিংহাসনচ্যুত করেন। এমনকি তাকে হত্যার পেছনেও তাদের ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। কৌশলে কোসেম সুলতান তার পুত্র চতুর্থ মুরাদকে ১৬২৩ সালে সিংহাসনে বসাতে সক্ষম হন। সুলতান চতুর্থ মুরাদ অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায়, তার পক্ষে কোসেম সুলতান সাম্রাজ্য পরিচালনা করা শুরু করেন। এ সময় তিনি ‘নায়েব-ই-সালতানাত’ পদবি গ্রহণ করেন। ১৬২৩-৩২ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল ছিলেন। এ সময় তিনি গুরুত্বপূ্র্ণ রাজপ্রতিনিধি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
সুলতান চতুর্থ মুরাদ সিংহাসনে বসার পর থেকে কোসেম সুলতান উসমানীয় সাম্রাজ্যের শীর্ষে চলে আসেন। হেরেমের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাথে সাথে রাজকার্যেও তার সিদ্ধান্ত সাদরে গৃহীত হতো। মুরাদ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ক্ষমতা নিজে পরিচালনা করতে শুরু করলেন। কয়েক বছরের মধ্যে সাম্রাজ্যে বিশৃংখলা দেখা দেয়। উত্তর আনাতোলিয়ায় বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায় এবং পারস্যের সাফাভিরা গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর দখল নিতে শুরু করে। এরই মধ্যে জেনিসারি বাহিনী বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এবং উজির-ই-আজমকে মেরে ফেলে। এসব দেখে সুলতান চতুর্থ মুরাদ খুব ভীত হয়ে পড়েন। সেই সময় থেকেই কোসেম সুলতান শক্ত হাতে ক্ষমতা পরিচালনা করেন। তিনি হারেমের পর্দার আড়াল হতে বেরিয়ে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে থাকেন। কঠোর হাতে সেই বিদ্রোহ দমন করেন। জেনিসারি বাহিনীরাও তাকে মান্য করে চলতেন। ১৬৪০ সালে সুলতান চতুর্থ মুরাদের মৃত্যু হলে কোসেম সুলতান তার একমাত্র জীবিত ছেলে ইব্রাহিমকে সিংহাসনে বসান। তিনি ১৬৪৭ সাল থেকে ভ্যালিদে সুলতান (রাজমাতা) হিসেবে বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেন। তিনি এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেন যে, জেনিসারি বাহিনী সুলতানের চেয়ে রাজমাতা কোসেমের আদেশ মানতেন বেশি। কিন্তু ইব্রাহিম রাজ্য পরিচালনার জন্য তেমন যোগ্য ছিলেন না। তার শাসনকালে বিভিন্ন জায়গায় বিদ্রোহ শুরু হয়। এর ফলে কোসেম আবার ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন।