হাতিরা পৃথিবীর বৃহত্তম স্থলচর প্রাণী, অত্যন্ত বুদ্ধিমান, তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তি এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা এবং পরিশীলিত যোগাযোগের জন্য পরিচিত। আগের গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, তারা একে অপরকে অভিবাদন করার সময় দৃষ্টি ও ধ্বনিগত স্পর্শকাতর অঙ্গভঙ্গি করে থাকে।কিন্তু হাতিরা কী পরস্পরকে মানুষের মতই নাম ধরে ডাকে? বছরের পর বছর ধরে হাতিদের নিয়ে গবেষণায় বিজ্ঞানীরা তেমনটাই লক্ষ্য করেছেন। যখন একটি হাতি অন্য একদল হাতির উদ্দেশে শব্দ করে তখন ওই দলের সব হাতি সাড়া দেয়। কিন্তু কখনো কখনো ওই একই হাতি ওই দলের উদ্দেশে প্রায় একই ধরনের শব্দ করে তখন মাত্র একটি হাতি সাড়া দেয়।কেনিয়ায় আফ্রিকার তৃণভূমির হাতিদের নিয়ে করা গবেষণা থেকে এই ধারণা। সে দেশের আম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্ক এবং সামবুরু জাতীয় সংরক্ষিত অঞ্চলের শতাধিক হাতির কণ্ঠস্বর বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। নিজেদের ভোকাল কর্ড ব্যবহার করে হাতিদের সৃষ্ট শব্দ বেছে নিয়েছেন তারা।গবেষণা ফলাফলে বলা হচ্ছে, হাতিরা যেসব আওয়াজ করে তার মধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত ডাকটিকে বলা হয় রাম্বল(গর্জন)। এই ডাকটি তিন রকম, দূরে যোগাযোগের জন্য ‘কন্ট্যাক্ট (যোগাযোগ)রাম্বল’, ঘনিষ্ঠ সাক্ষাতের জন্য ‘গ্রিটিং(অভ্যর্থনা)রাম্বল’ এবং স্ত্রী হাতিরা নিজেদের বাচ্চার সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যবহার করে ‘কেয়ারিগিভিং(যত্ন)রাম্বল’।
একটি মেশিন-লার্নিং মডেল ব্যবহার করে, গবেষকরা হাতির তিন ধরনের রাম্বল বিশ্লেষণ করেছেন। এরপর গবেষকরা রেকর্ড করা অডিও বাজিয়ে ১৭টি হাতিকে পরীক্ষা করেন।তারা ১৯৮৬ সাল থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কেনিয়ার অ্যাম্বোসেলি ন্যাশনাল পার্ক ও বাফেলো স্প্রিংস রিজার্ভে থাকা বন্য স্ত্রী হাতি ও বাচ্চা হাতির ৪৬৯টি রেকর্ড করা ডাক পরীক্ষা করে দেখেছেন, প্রতিটি হাতিকে কানের আকৃতির ওপর ভিত্তি করে শনাক্ত করা যায় কারণ সেগুলিকে কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল।আপাতভাবে তাদেরই ডাকা হচ্ছে এমন আওয়াজে তারা সাড়া দেয় কিনা এমন পরীক্ষার জন্য এই ১৭টি হাতিকে বেছে নেওয়া হয়। তারপর তাদের হাতির রেকর্ড করা আওয়াজের বিভিন্ন অডিও চালিয়ে শোনানো হয়।গবেষকরা দেখেছেন যে এই ডাকগুলিতে একটি নামের মতো উপদান আছে। ওই নামের মতো আওয়াজগুলির অডিও রেকর্ডিং বাজিয়ে গবেষকরা দেখেছেন, যখন তারা এই জাতীয় ডাক শুনছিল, আপাতদৃষ্টিতে তাদের সম্বোধন করা আহ্বানে হাতিরা গড়ে আরও দৃঢ়ভাবে সাড়া দিয়েছিল।এর থেকে বোঝা যায়, ডাকটি সেই হাতিকেই উদ্দেশ্য করে দেওয়া হয়েছে কিনা তা শনাক্ত করার ক্ষমতা হাতিগুলির রয়েছে। যখন তারা এমন ডাক শুনছিল তারা আরও উৎসাহভরে সাড়া দিচ্ছিল, হেঁটে অডিও শব্দের উৎসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল আর বিভিন্ন শব্দ করছিল। পরে অন্য কোনো হাতির উদ্দেশে করা শব্দে আগের হাতিটি আর তেমনভাবে সাড়া দিচ্ছিল না।
নিউইয়র্কের কর্নেল ইউনিভার্সিটির আচরণগত পরিবেশবিদ ও নেচার ইকোলজি এন্ড এভোল্যুশন সাময়ীকিতে প্রকাশিত এই গবেষণার প্রধান লেখক মিকি পারডো তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, মানুষের ডাক নামের মতো হাতিরা একইভাবে সাড়া দেয় কিনা তা নির্ধারণ করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। নির্দিষ্ট হাতির ডাকের শব্দ বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে অন্য কোনো হাতির উদ্দেশ্যে সেই হাতিটি ডাক দিয়েছে সেটি নির্ণয় করার চেষ্টাই তারা করেছেন। আর তাতে ইঙ্গিত পেয়েছেন হাতিরা ‘একে অন্যকে নামের মতো কিছু ব্যবহার করে ডাকে’।পারডো আরও বলেন, “এভাবে পরস্পরকে সম্বোধন করার জন্য হাতিদের অবশ্যই নির্দিষ্ট একজনের সঙ্গে নির্দিষ্ট শব্দ যুক্ত করতে আর তারপর সেই শব্দগুলি বিশেষ জনের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ব্যবহার শিখতে হবে, নিশ্চিতভাবেই এটি নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে; এটি করতে উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা ও সামাজিক সম্পর্ক উপলব্ধির ক্ষমতা থাকতে হবে।
একটি হাতি কেন অন্য হাতিকে ‘নাম’ ধরে ডাকবে?কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানী এবং গবেষণার সহ-লেখক, সংরক্ষণ গ্রুপ ‘সেভ দ্য এলিফ্যান্টস’ এর বৈজ্ঞানিক বোর্ডের চেয়ারম্যান জর্জ উইটেমায়ার বলেছেন, “আমরা পুরোপুরি জানি না, তবে আমাদের বিশ্লেষণ থেকে সাধারণভাবে দেখা যাচ্ছে যোগাযোগের সময় একটি হাতি অন্য হাতিকে ডাকে।” মেশিন-লার্নিং মডেলটি মা হাতির সঙ্গে বাচ্চার যোগাযোগের সময় ব্যবহৃত ডাককে আরো সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে। গবেষকরা মনে করছেন, মা হাতি সন্তানকে ডাকার সময় আরো বেশী করে নাম ব্যবহার করায় সেটি আরো সঠিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।স্বতন্ত্র-নির্দিষ্ট ভোকাল লেবেল ব্যবহার করা যাকে ‘নাম’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় তা প্রাণীজগতে বিরল, তবে অভূতপূর্ব নয়।ডলফিন এবং টিয়াপাখিদেরও এটি করতে দেখা গেছে। কিন্তু তারা যখন এটি করে, তখন তারা কেবল অন্য প্রাণীর কণ্ঠস্বর দ্বারা তৈরি শব্দ অনুকরণ করে।