বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উপকণ্ঠ দিয়ে বয়ে গিয়েছে যে নদী “তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস।স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতের চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না”। এই নদীর নাম তিতাস। নদী পাড়ের একটি গ্রাম গোকর্ণঘাট। সেখানকার মানুষেরা ছিলেন মৎস্যজীবী, যারা মল্ল বা মালো সম্প্রদায়ের। ত্রিপুরা-কুমিল্লা অঞ্চলের কৈবর্ত সমাজের অন্যান্য বর্গের প্রধান এই মালো। কিন্তু বর্ণহিন্দু সমাজের চোখে তাঁরা ছিলেন ব্রাত্য। কিন্তু ব্রাত্যজনের সেই রুদ্ধ দ্বার ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। তাঁর জন্ম ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি এই তিতাস পাড়ের গোকর্ণঘাট গ্রামের দরিদ্র এক মালো পরিবারে।
মালোপাড়ার ছেলে অদ্বৈত মল্লবর্মণ ‘মোহম্মদী’ নামক একটি মাসিক পত্রিকায় চাকরি করার সময় ধারাবাহিকভাবে সাতটি সংখ্যায় লিখেছিলেন এই উপন্যাসের প্রথম খসড়া। উল্লেখ্য, একই সঙ্গে তিনি ‘দৈনিক আজাদ’পত্রিকাতেও কাজ করতেন। মাঝপথে পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় ধারাবাহিক লেখা তিতাস তখনকার মতো থেমে যায়। এরপর অদ্বৈত মল্লবর্মণ কলকাতায় আসেন রোজগারের আশায়, কলকাতায় বসে তিনি তাঁর তিতাসের খসড়াটিকে সম্পাদনা করে বাকি অংশটি লেখেন। তবে তাঁর জীবদ্দশায় উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়নি। তাঁর মৃত্যুর চার বছর পর ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস আকারে প্রকাশিত হয়।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ ১৯৪৫ সালে সাগরময় ঘোষের আগ্রহে আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠীর ‘দেশ’পত্রিকায় যোগ দিয়েছিলেন। এই পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে তাঁর একটি রচনা ‘জীবনতৃষা’ প্রকাশিত হয়। এটি চিত্রশিল্পী ভ্যান গগ্-এর জীবন অবলম্বনে আরভিং স্টোনের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস ‘লাস্ট ফর লাইফ’-এর অনুবাদমূলক রচনা। অনেকেই এটিকে নিছক অনুবাদ বলতে নারাজ, তাদের মতে এটি অদ্বৈত মল্লবর্মণের নিজের জীবনের কথা। যে কারণে তারা ভ্যান গগ্ এবং অদ্বৈত মল্লবর্মণের মানবিক ও শৈল্পিক উপস্থাপন নিয়ে দু’জনকে সম্ভবনার সহযাত্রী আখ্যা দিয়েছেন।
কলকাতায় অদ্বৈত ভাগ্য ফেরাতে পারেন নি। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা বেরোয় ঠিকই কিন্তু সব লেখা কাজের তাগিদে নয়। আসলে অদ্বৈত নিজের যাপন করা জীবন, ফেলে আসা অতীত, সেই প্রান্তিক এবং অবহেলিত মালোদের কথা এক বারের জন্যও ভোলেননি।‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ যেমন সমাজে অপাংক্তেয় নিন্মবর্গীয়দের কথা লিখেছেন তেমনি সেই ব্রাত্যদের জন্য ভেবেছেন এবং ছোটাছুটি করেছেন।কখনও নিজের খেয়াল নেননি। মেসবাড়িতে থাকার খরচাপাতি সামলে, খাওয়াদাওয়ার দিকে তেমন নজর দিতে পারেননি। এক দিকে দরিদ্র স্বজনদের চিন্তা আর অন্য দিকে ঘুরে ঘুরে নানা ধরনের বই কেনা— সাহেবরা তখন কলকাতা ছাড়ছেন, তাঁদের সংগ্রহের বইপত্র অল্প দামে বেচে দিচ্ছেন । কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় জমে উঠছে পুরনো বইয়ের দোকান, অদ্বৈত ঘুরে ঘুরে সেই সব বই নিজের সংগ্রহে রাখতে শুরু করেন। তাত বেশ টাকাপয়সা খরচা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর সে সব বই রামমোহন লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়।
দিনের পর দিন স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে তিতাস পারের মালো পরিবারগুলি উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমবঙ্গে এসে পড়লে তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে দেখা করা, তাদের অর্থ সাহায্য- অতিরিক্ত রোজগার করতে তাঁকে বিশ্বভারতীর গ্রন্থন বিভাগে আংশিক সময়ের কাজও নিতে হয়। কিন্তু শারীরিক পরিশ্রম ও মানসিক ধকল— এক সময়ে তাঁর যক্ষা ধরা পড়ে। নিজেও জানতেন এই ক্ষয়রোগের কথা কিন্তু কাউকেই তাঁর রোগের কথা কিছু বলতেন না, চাকরির নিরাপত্তার কারণে, তাই রোগ গোপন করেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শেষমেশ তাঁকে কাঁচড়াপাড়ার যক্ষা হাসপাতালে ভর্তি হতেই হয়। স্বভাবে অদ্বৈত মোটেও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর দিন গোনার মানুষ নন, তার উপর এক দিকে অসমাপ্ত উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’আর অন্য দিকে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা তাঁকে শুভানুধ্যায়ীদের শত অনুরোধক এড়িয়ে নারকেলডাঙার ষষ্ঠীতলা রোডের বাড়িতে নিয়ে আসে। ওই বাড়িতেই অদ্বৈত মল্লবর্মণের মৃত্যু হয়।