শাসক যখন জনগণের বিক্ষোভ প্রতিবাদ উপেক্ষা করে শাসন চালিয়ে যায় তখন সেই শাসকের সঙ্গে জুলিও-ক্লডিয়ান রাজতন্ত্রের সম্রাটের তুলনা করে বলা হয়, “রোম যখন পুড়ছিল, নিরো তখন বেহালা বাজাচ্ছিলেন”। কিন্তু এই ঘটনা কতখানি সত্য? ৬৪ খৃস্টাব্দে ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডে রোমের বেশিরভাগ এলাকা পুড়ে গিয়েছিল। গুজব ছড়িয়েছিল যে নিরো আগুন লাগিয়েছিলেন। কেবল তাই নয়, পরে বলা হয় যে রোম নগরী যখন পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি বেহালা বাজাচ্ছিলেন। ঐতিহাসিকেরা এই তথ্যকে সঠিক মনে করেন না। কারণ, সেই আমলে বেহালার অস্তিত্ব ছিল না। তবে নিরো বীণা জাতীয় একটি বাদ্যযন্ত্রের বাজানা শুনতে পছন্দ করতেন। ঐতিহাসিকরা এও মনে করেন যে রোমের অগ্নিকাণ্ডের জন্যে নিরো দায়ী নন। কারণ এই আগুনে নিরোর নিজের প্রাসাদও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কেবল তাই নয়, অগ্নিকাণ্ডের পর তিনি রোম নগরীকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়েছিলেন।
তবে নিরো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় খ্রিস্টানদের দায়ী করেছিলেন। এর পিছনেও কারণ ছিল, তিনি তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ থেকে নিজেকে বাঁচাতেই খ্রিস্টানদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়েছিলেন। রোমে ওই সময়ে খ্রিস্টানরা ছিল সংখ্যালঘু। বলা হয়, শহরে আগুন দেওয়ার শাস্তি হিসেবে নিরো খ্রিস্টানদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলেন। তাদের ক্রুশবিদ্ধ করে, বন্য জন্তু দিয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে, তাদের গায়ে আগুন লাগিয়ে শাস্তি দেন এবং উৎসব পালন করেন, সেখানে লোকজনকে নিমন্ত্রণ করেন। রোমের সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর নিরো দুটি পাহাড়ের মাঝখানে বিশাল একটি প্রাসাদ নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন। সেখানে নাকি সোনার তৈরি একটি ঘর ছিল। ওই ঘরের ভেতরে ছিল ঘূর্ণায়মান টেবিল এবং ঘরের দেওয়ালগুলিতে বসানো পাইপ দিয়ে সুগন্ধি প্রবাহিত হত। সেই প্রাসাদ নির্মাণে বহু ব্যয় হলেও কাজ কখনোই শেষ হয়নি। গোটা শহর যখন আগুনের ধ্বংসস্তুপ থেকে জেগে ওঠার চেষ্টা করছিল, তখন শহরের লোকজন দেখছিল তাদের সামনে এমন বিলাসবহুল একটি প্রাসাদ তৈরি করা হচ্ছে।
সৎ বাবা সম্রাট ক্লডিয়াসের মৃত্যুর পর মাত্র ১৭ বছর বয়সে মায়ের সাহায্যে নিরো সম্রাট হন।তার মা এগ্রিপিনা দ্য ইয়াঙ্গার ছিলেন প্রথম সম্রাট অগাস্টাসের সরাসরি বংশধর। তার ভাই সম্রাট ক্যালিগুলা, নিরোর আগে যিনি সবচাইতে অত্যাচারী রোমান সম্রাট হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তার সৎ পিতামহ টিবেরিয়াসকে হত্যা করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। টিবেরিয়াস হত্যা দিয়েই শুরু হয়েছিল জুলিও-ক্লডিয়ান পরিবারের ভাতৃহত্যার ইতিহাস। নিরোর জন্মের পর ক্যালিগুলা তার বোন এগ্রিপিনার সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে একটি ছোট্ট দ্বীপে নির্বাসিত করেন। অত্যাচারী ক্যালিগুলার কারণে শিশু নিরোর বেঁচে থাকা অসম্ভব ছিল। দুর্ভাগ্যবশত প্রিটোরিয়ান রক্ষীবাহিনীর ছুরিকাঘাতে ক্যালিগুলা নিহত হন। প্রিটোরিয়ান বাহিনী এগ্রিপিনার সৎ কাকা ক্লডিয়াসকে সম্রাট ঘোষণা করে। ক্লডিয়াস এগ্রিপিনাকে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে আনেন।
কিন্তু এগ্রিপিনা সম্রাট ক্লডিয়াসকে চাপ প্রয়োগ করে তার একজন কাউন্সেলকে বিয়ে করেন। পরে তাকে কৌশলে হত্যা করে তার সমস্ত সম্পত্তির মালিক হন। অন্যদিকে ক্লডিয়াস তার নিজের স্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে এগ্রিপিনাকে বিয়ে করেন। এগ্রিপিনা ক্লডিয়াসকে বাধ্য করেছিলেন নিরোকে দত্তক নিতে এবং তার একমাত্র কন্যা ক্লডিয়া অক্টাভিয়ার সঙ্গে বিয়ে দিতে। স্ত্রীর পরামর্শে ক্লডিয়াস তার পুত্র ব্রিটানিকাসের পাশাপাশি নিরোকে উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করেন। সম্রাট ক্লডিয়াস হঠাৎ মারা যান। ধারণা করা হয়, ক্লডিয়াসের খাদ্য পরীক্ষককে ঘুষ দিয়ে খাবারে বিষ মিশিয়েছিলেন এগ্রিপিনা। এরপর বালক নিরোকে সিংহাসনে বসিয়ে এগ্রিপিনা নিজেকে রোমান সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছিলেন। যদিও ক্ষমতায় এসে নিরো মাকে নিজের প্রধান উপদেষ্টা বানালেও পরে শিক্ষাগুরু ও বিদ্বান দার্শনিক সেনেকার পরামর্শে মায়ের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসেন নিরো। পাশাপাশি এগ্রিপিনার অমতে পপেয়া সাবিনার প্রতি অনুরক্ত হন তিনি, পরবর্তীকালে তাকে বিয়েও করেন।
জুলিও-ক্লডিয়ান রাজতন্ত্রের কুখ্যাত সম্রাট নিরো মাত্র ৩০ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন। তার শাসনকালের প্রথম পাঁচ বছর ছিল রোমানদের স্বর্ণযুগ। মন্ত্রণা পরিষদের স্বাধীনতা বাড়ানো, গোপন বিচারের নামে হত্যা ও দুর্নীতি কমানো, খেলাধুলা ও বিনোদনভিত্তিক অনুষ্ঠান আয়োজন ইত্যাদি কারণে রোমানদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন নিরো। তিনি কর কমিয়ে, দাস অধিকার বাড়িয়ে নিজেকে জনপ্রিয় করার পাশাপাশি খেলাধুলার নামে প্রাণী হত্যা ও রক্তক্ষয়ী গ্ল্যাডিয়েটর কমব্যাট বন্ধ করে গ্রিক কুস্তি চালু করেন।কিন্তু হিংসা ও নিষ্ঠুরতার পূজারী নিরোর আসল রূপ ফুটে উঠতে বেশি সময় লাগেনি। রাজনৈতিক খুন, লাম্পট্য, খ্রিষ্টানদের উপর অমানবিক অত্যাচার নিরোকে শীঘ্রই পরিণত করে একজন অত্যাচারী সম্রাটে। নিরো নিজের মাকে ও স্ত্রীকেও হত্যা করেছিলেন। একসময় তিনি রাজকার্য থেকে সাময়িক বিদায় নিয়ে রোমান সাম্রাজ্যের পূর্ব প্রদেশে চলে যান। নানা রকম পাগলামি ছিল তার, নিরো থিয়েটার করতে খুব পছন্দ করতেন, তিনি বীণা জাতীয় একটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন, গান গাইতেন, কবিতা লিখতেন এবং মঞ্চে অভিনয়ও করতেন। গ্রিসে, তিনি সাধুবেশে খালি পায়ে হাটতেন। তিনি যেখানেই যেতেন, সে শহরকে স্বাধীন হিসেবে মঞ্জুর করতেন।
৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুলাই ঘুম থেকে উঠে, নিরো নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করে প্রথমে তাকে সাহায্য করার জন্য ও পরে হত্যা করার জন্য চিৎকার করেন। বুঝতে পেরে সকলেই নিরোকে ছেড়ে গিয়েছিল। উন্মাদ রাজা তখন বিলাপ শুরু করেন, “আমার কি কোনো বন্ধু নেই, শত্রুও নেই?” নিরোর বন্ধু না থাকলেও শত্রুর অভাব ছিল না। সেটা বুঝেই তিনি পালিয়ে যান ও শেষমেশ আত্মহত্যা করেন।