অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশনের পর একটি ছেলেকে তাঁর মা এক বাক্স রঙ পেন্সিল কিনে দিয়েছিলেন, ছেলেটি তখন আইনের ছাত্র, বয়স কুড়ি। বাড়িতে বসে ছেলেটি রঙ পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকতে আঁকতে এমনই মজে গেলেন যে আইন ছেড়ে শিল্পকলার শিক্ষা নিতে প্যারিস চলে গেলেন। পরবর্তীতে সেই ছেলেটি বলেছিলেন, এই রঙ ও রেখার জাদুতে এক নতুন স্বর্গের দরজা খুলে গিয়েছিল তাঁর সামনে। যতদিন পর্যন্ত তিনি রং-তুলি নিয়ে বসেছেন ততদিন তিনি সেই ব্যক্তিগত স্বর্গের প্রতিচ্ছবি রচনা করে গিয়েছেন নিরন্তর রঙ, রেখা আর আলোর উদ্ভাসনে। একদিন তিনি বলেছিলেন, তিনি এমন জাতের ছবি আঁকতে চান যা দর্শকের ইন্দ্রিয়কে শান্ত ও সমাহিত করবে, তার দিন প্রতিদিনের গ্লানি ও যন্ত্রণার প্রশমন ঘটাবে। তাঁর কথাটি ছিল খুবই সত্য, অঁরি মাতিসের ছবিতে চোখ রাখলে বোঝা যায় যে তাঁর রং-রেখার প্রকৃতি কিংবা মানুষেরা কোনোভাবেই চোখকে এতটুকু পীড়িত করে না, তাদের দেখে চঞ্চল হয়ে ওঠে না মন। তাঁর ছবি জুড়ে বিষয় ও আঙ্গিকে কোথাও কোনো অসুন্দর প্রকাশ নেই, নেই কোনো নিষ্ঠুরতা। আধুনিক নগরজীবনের কোনো জটিলতা, কোনো যন্ত্রণা এমনকি কোনো সমস্যাকেই মাতিস তাঁর সমগ্র শিল্পীজীবনের বিশাল চিত্রসম্ভারের কোথাও গভীর কিংবা আলগা ভাবেও আমল দেননি। আর সেই কারণেই তাঁর ছবিতে আধুনিক নগরজীবন চেতনার কোনো স্পর্ষ আমদের চোখে ধরা পড়ে না।
মূলত নিসর্গ, সেই সঙ্গে অনাদি অকৃত্রিম মানুষ ও তার বস্তুময় পরিপার্শ্ব মাতিসের ছবির বিষয়। অজস্র উদ্দাম রঙ মাখিয়ে মাতিস তাদের নির্মাণ করেন এমন আশ্চর্য সারল্যে যেখানে কোনো জটিলতা, কৃত্তিমতা ঠাঁই পায় না। মাতিস তাঁর ছবির একটি সিরিজের নামকরণ করেছিলেন ‘Joie de Vivre’ বা বাঁচার আনন্দ। বোঝা যায় তাঁর ছবির রঙ-রেখা ঘুরেফিরে জীবনের সহজ, সরল আনন্দের অনুসন্ধান করেছে। মাতিসও একসময় আর পাঁচজন চিত্রকরের মতো স্থিরচিত্র দিয়ে শুরু করেছিলেন। তবে সেই সব ছবিতে যত না তাঁর নিজস্বতা বা স্বতন্ত্রতা থাকতো তার চেয়ে বেশি থাকতো ক্লদ মনে আর রেনোয়ারের প্রভাব। বলা যায় Still life with a Blue Tablecloth প্রথম তিনি তাঁর কাজে নিজস্বতা নির্মান করলেন, এই কাজটিতে তাঁর মৌলিকতার আভাসও পাওয়া যায়- টেবিলের অজস্র দ্রব্যসম্ভারের তলা থেকে অল্প কিছু নীল রেখার ঝলকে টেবিলক্লথের ইঙ্গিতময় উপস্থাপনায়। এই সময়কার তাঁর আরও একটি কাজ হল The Dinner Table নামক Still life। এই কাজটিতেও বহুস্তর বিন্যাসের মধ্যে শিল্পীর অসাধারণ মুন্সিয়ানা লক্ষ্য করা যায়। যদিও মাতিসের বহু কাজের মধ্যেই তাঁর গুরু পল সেজানের জ্যামিতিক কম্পোজিশনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে Male Model চিত্রকর্মটিতে, যেখানে ভাস্কর্যের ঘনত্ব নির্মিত হয় রেখার নৈপুণ্যে।
মাতিস ১৯০৫ সালের গ্রীষ্মকাল কাটিয়েছিলেন ভূমধ্যসাগর সৈকতে শিল্পী Andre Derain-এর সঙ্গে। এই সময় মাতিসের ছবিতে রঙের প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায়, মাতিসের ক্যানভাসে রঙের এই ঘনত্ব যে গগ্যাঁ ও ভ্যান গঘের প্রভাব তা বলাই বাহুল্য। পরবর্তীতে মাতিস Derain, Matisse ও Vlaminck মিলে একটি প্রদর্শনী করেন, সেই প্রদর্শনীর ছবি দেখে দর্শক, সমালোচক সবাই খুব চমকে উঠলেন। বিশেষ করে মাতিসের ক্যানভাসে রঙের ব্যবহার দেখে তাদের মনে হয়েছিল বেহিসেবি এবং ব্যাকরণহীন। সমালোচকেরা তো মাতিসকে একরকমভাবে উন্মাদ ভেবে বসলেন এবং তাঁরা মাতিসকে Les Fauves বা বন্য জন্তু আখ্যা দিয়ে বসলেন। কিন্তু একথা ঠিক কেবলমাত্র উজ্জ্বল রঙ নয়, সেই সঙ্গে রূপকল্পের এমন ঠাস বুনট, এর আগে ছবিতে দেখা যায় নি। রঙের ব্যবহার নিয়ে মাতিস জানিয়েছিলেন, তিনি ছবি এঁকে তাতে রঙ ভরে দেওয়ার থেকে সরাসরি রঙ দিয়েই গোটা ছবিটা আঁকতে চেষ্টা করছেন, যাতে খোদ রঙই ছবির ভাষা হয়ে ওঠে। মাতিসের এই সময়কার এবং পরবর্তীতেও ছবির আনাচে-কানাচে যে বিচিত্র আলোর খেলা লক্ষ্য করা যায়, তাও তাঁর গাঢ় রঙ ব্যবহারের কারণে। মাতিসের ভাষায় তিনি রঙ ব্যবহার করে কোনো নির্দিষ্ট আলোকে অনুকরণ করেন না, বরং নিজস্ব প্রয়োজনে নতুন নতুন আলো তৈরি করে নেন রঙের বিচিত্র বিন্যাসের মাধ্যমে।
উজ্জ্বল ও গাঢ় রঙের প্রতি মাতিসের পক্ষপাতিত্ব ছিল সারা জীবন। যদিও মধ্যবর্তী এক পর্যায়ে কিছুদিনের জন্য সেই রং ফিকে হয়ে গিয়েছিল, তবে শেষ জীবনে তাঁর অভিনব paper cutout গুলির মধ্যে ফের উজ্জ্বল ও গাঢ় রঙের রং বন্যার প্রবল স্রোতের মতো তাঁর ক্যানভাসগুলির উপর বয়ে চলে। প্রদর্শনীগুলির অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হয়ে উঠতো তাঁর উজ্জ্বল বর্ণিল কাগজ কেটে বানানো আশ্চর্য সুন্দর ও বাঙ্ময় কাটআউটগুলি। পারস্যের মিনিয়েচারে প্রভাবিত হয়ে মাতিস যে Interior পর্যায়ের অসংখ্য কাজ করেছিলেন তাতেও অলংকরণের এক নতুন মাত্রা লক্ষ করা যায়। বস্তুত এ অলংকরণপ্রিয়তা, প্রাকৃতিক সারল্য আর বহুবর্ণিল ঔজ্জ্বল্যের জন্য অন্য মাতিসকে পাওয়া যায়। এছাড়া মালার্মের কবিতার বইয়ের Illustration এবং তার নিজের লেখা ও আঁকা Jazz গ্রন্থের মূল ছবিগুলিও উল্লেখের দাবি রাখে। ছবির ভাষায় এই যে বহুবিধ রূপ আর আলোর সরল স্বতঃস্ফূর্ততা, বস্তুর Essential Character ফুটিয়ে তুলতে মাতিস সারা জীবন সাধনা করে গিয়েছেন এটাই প্রকৃত শিল্পী বা স্রষ্টার পরিচয়।