বঙ্গসমাজরাজনীতিতে থ্রেট কালচার কথাটি এখন বহুল প্রচলিত। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ঘটনার পর কথাটি সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্রেই সর্বস্তরের মানুষ বলছেন এবং শুনছেন। সমাজ ও রাজনৈতিক বিশেষঙ্গদের একাংশের দাবি, ‘এই থ্রেট কালচারের জন্ম বাম আমলেই। এর অজস্র উদাহরণ রয়েছে। নয়ের দশক থেকে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে জুনিয়র ডাক্তারদের উপরে চলত র্যাগিং বা অত্যাচার। সেই সময়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভোগ করা ছাত্রনেতারাই নাকি থ্রেট কালচারের সূচনা করেছিলেন।
প্রসঙ্গত, রাজ্যের হাসপাতালগুলি থেকে যখন ভুড়ি ভুড়ি থ্রেট কালচারের অভিযোগ জমা হচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে সরগরম হয়েছে বাংলা, ঠিক সেই আবহে টলিউডেও নাকি থ্রেট কালচার চলছে রমরমিয়ে, এমন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। কারণ দীর্ঘদিন কাজ না পেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন টলিপাড়ার এক হেয়ার ড্রেসার। অভিযোগ, তনুশ্রী দাস নামের ওই কেশশিল্পী বা Hairdresser-এর হাত থেকে একের পর এক কাজ কেড়ে নিতে থাকে হেয়ার ড্রেসার গিল্ড ও ফেডারেশনের লোকজন। কাজ হারিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তিনি অবসাদে ভুগছিলেন। সেই হতাশা থেকেই শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ওই শিল্পী, এমনটাই অভিযোগ তাঁর পরিবারের লোকজনের। গত শনিবার রাত ঠিক আটটা নাগাদ বাড়ির বাথরুম ঢুকেছিলেন ওই কেশশিল্পী। কিন্তু, দীর্ঘক্ষণ সেখান থেকে না বেরনোয় সন্দেহ হয় তনুশ্রী দেবীর মেয়ে অঙ্কিতার! বাথরুমে দরজার কাছে যেতে কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া যায়, দরজা ভেঙে অঙ্কিতা উদ্ধার করেন নিজের মাকে। গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন ওই শিল্পী। তারপর থেকে তিনি ভর্তি রয়েছেন বাঙ্গুর হাসপাতালে।
সূত্রের খবর, হেয়ার ড্রেসার গিল্ড তনুশ্রী দেবীকে তিন মাসের জন্য কাজ থেকে সাসপেন্ড করে। পরবর্তীকালে তাঁকে বলা হয় গিল্ড যে কাজ দেবে সেই কাজই শুধু তিনি করতে পারবেন। বাইরে থেকে কোনও কাজ নিয়ে এলে তিনি করতে পারবেন না। এরইমধ্যে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবির জন্য বড় কাজের অফার তিনি পান। যদিও শেষ পর্যন্ত সেখানেও বাধা! একদিন আগে জানতে পারেন ওই কাজও তিনি করতে পারবেন না। গিল্ডের তরফেই তাঁকে এ কথা নাকি তাঁকে জানানো হয়।
গিল্ডের কাছ থেকে এ কথা শোনার পরেই চরম হতাশায় ভুগতে থাকেন তনুশ্রী দেবী। অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয় বাড়িতে। কিন্তু, তারমধ্যে যে তিনি একেবারে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে ফেলবেন তা ভাবতে পারছে না কেউই। একটি সুইসাইড নোটও উদ্ধার হয়। তাতে দশজনের নামও রয়েছে বলে খবর। তার ভিত্তিতে রাতেই হরিদেবপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়। অন্যদিকে রাতেই তনুশ্রী দেবীকে দেখতে হাসপাতালে যান সহকর্মীরা। তাঁদের অভিযোগও একই। গিল্ডের দাদাগিরি এবং শাসানির কথা বলতে গিয়ে চোখে জল তাঁদেরও।
টলিপাড়াতেও যে থ্রেট কালচারের রমরমা রয়েছে তা একের পর এক টলিপাড়ার কলাকুশলিদের কথা থেকেই জানা যাচ্ছে। আর প্রত্যেকেরই অভিযোগের আঙুল গিল্ডের বিরুদ্ধে। জানা গিয়েছে, সিলেকশনের বদলে ইলেকশন চাওয়ায় তিনমাস আগে সাসপেন্ড করা হয়েছিল ওই হেয়ার ড্রেসারকে। পরে তিনি কাজে যোগ দিলেও বেশ কয়েকটি শর্ত দেওয়া হয়। তাঁকে বলা হয় বাইরে থেকে তিনি নিজে কোনও কাজ ধরতে পারবেন না। সংগঠন তাঁকে যা কাজ দেবে সেটাই করতে হবে। সমস্ত শর্ত মেনে নিলেও তাঁর একের পর এক কাজ কেড়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ। শনিবার সাধারণ সদস্যদের একটি হোয়াটসঅ্য়াপ গ্রুপে বিস্তারিত জানিয়ে একটি ভয়েস ম্যাসেজ করেন ওই হেয়ার ড্রেসার। সেখানে তিনি আত্মহত্যার কথা বলেন। সেখানে তিনি আরও বলেন, তাঁর স্বামী অসুস্থ, মেয়ে পড়াশোনা করছে, এমতাবস্থায় তাঁর কাজ না থাকায় বিপুল ঋণে জর্জরিত হয়ে যান তিনি। এবং তারপরেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন।
‘থ্রেট কালচার’বা ‘হুমকি সংস্কৃতি’এই শব্দবন্ধের জন্ম যদিও মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ‘হুমকি’ থেকে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কলেজে র্যাগিং থেকে। যা নাকি মাত্র কয়েক দিনের বিষয় নয়। লাগাতার চলতে থাকা ‘দাদাগিরি’ এবং ‘হুমকি’ থেকেই পাকাপোক্ত হয়ে ওঠা এক ব্যবস্থা। এর পিছনে রয়েছে ‘আনুগত্য’ লাভের ইচ্ছা এবং ‘নিয়ন্ত্রণ’ করার চেষ্টা। টলিউড পরিচালকদের থেকে পাওয়া খবর, মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন কাউকে বয়কট বা সাসপেন্ড করা যাবেনা। যদিও হেয়ার ড্রেসারের আত্মহত্যার চেষ্টার পর অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একাংশ সরব হয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। কেউ কেউ ফেসবুক পোস্টে রীতিমতো ক্ষোভ প্রকাশ করে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন এর শেষ দেখে তিনি ছাড়বেন।