দীর্ঘদিন ধরেই শ্রীলঙ্কায় দ্বিদলীয় ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির চল। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকেই সে দেশের রাজনীতিতে বেশির ভাগ সময় শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি ও ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি তাদের নিজের দল ও জোটের আধিপত্য বজায় রেখেছিল। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই দুটি দলের প্রভাব ও অবস্থান যে নড়বড়ে হতে শুরু করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেল গত শনিবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে। ২০২২ সালে এপ্রিল-জুলাই মাসে অস্বাভাবিক হারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, পণ্য সংকট ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে এক নজিরবিহীন বিদ্রোহ ও জনবিক্ষোভের মুখে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসে সিঙ্গাপুর পালিয়ে যান। সেই সময় রনিল বিক্রমাসিংহে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্বভার নিয়েই তিনি অভ্যুত্থানকারী নেতাকর্মীকে ধরপাকড় ও তাদের উপর নির্যাতন শুরু করেন।
সেই সময় ‘জনতা বিমুক্তি পেরামুনা’ (জেভিপি) দলের প্রধান অনুরা ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন করে শ্রীলঙ্কার রাজনীতির একেবারে সামনে চলে আসেন। তিনি অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক ছাত্র-জনতার ওপর অন্যায় নিপীড়নের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষের আস্থা অর্জন করেন। শ্রীলঙ্কায় ২০২২-এর জুলাই মাসে যে অভ্যুত্থান হয় অনুরা ও তাঁর দল সেই গণবিক্ষোভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গণবিক্ষোভের মুখে গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালানোর পর জেভিপি বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেয়। সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলটির অনড় অবস্থান দেখে শ্রীলঙ্কাবাসী জেভিপির প্রতি আকৃষ্ট হয়। এদিকে জেভিপির জনমুখী কর্মসূচির পাশাপাশি অনুরা কুমারা দিশানায়েকের ব্যক্তিগত আবেদন ও জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকে। তাঁর এই জনপ্রিয়তা বাড়ার প্রধান কারণ, তিনি স্বজনপ্রীতি ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির উল্টোদিকে গণতান্ত্রিক, সামাজিক ভারসাম্যমূলক বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের স্বার্থের কর্মসূচি শ্রীলঙ্কাবাসীর সামনে হাজির করেন।
প্রসঙ্গত, দিশানায়েকের জন্ম শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বো থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে অনুরাধাপুরা জেলার থাম্বুতেগামা গ্রামে এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর বাবা ছিলেন একজন দিনমজুর ও মা গৃহিণী। শৈশব থেকে কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং জেভিপির সশস্ত্র আন্দোলনে যুক্ত হন। এরপর দিসানায়েক জেভিপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে যোগ দেন এবং জাতীয়তাবাদী তালিকা থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি এলটিটিইর (তামিল বিদ্রোহী গোষ্ঠী) বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য লড়াই করেন। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৩৮ জন প্রার্থীর মধ্যে অনুরা কুমারা দিশানায়েকে ছিলেন তুলনামূলকভাবে অপরিচিত। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে ছিলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের ছেলে নমাল রাজাপাকসে, প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে সজিথ প্রেমাদাসা এবং দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট জে আর জয়াবর্ধনের ভাগনে ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা তাঁর তুলনায় রাজনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ছিলেন অনেক বেশি প্রভাবশালী ও প্রতিষ্ঠিত। তাদের পরাজিত করে অনুরা কুমারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে পরিবারের দেড় দশকের বেশি সময়ের একক আধিপত্যের অবসান ঘটল।
প্রথমবার নির্বাচনে অংশ নিয়েই দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হলেন। তাঁর দল ও জোট আগে কখনও শ্রীলঙ্কার বিরোধী দল হিসেবেও ক্ষমতার কাছাকাছি ছিল না। ২২৫ জন সদস্যের আইনসভায় নবগঠিত এই জোটের আসন ছিল মাত্র তিনটি। প্রভাবশালী পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির বাইরে তৃতীয় শক্তি হিসেবে বামপন্থিদের উত্থান সত্যিই অভাবনীয়। কারণ, জেভিপির ঘুরে দাঁড়ানোর কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। দীর্ঘ সংগ্রাম ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়েই তাদের এগিয়ে যেতে হয়েছে। সত্তর-আশির দশকে এই দল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দু’বার বিদ্রোহ করেছিল। তার পরিণতিতে তাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে কারাবন্দি হতে হয়েছিল, অনেককে প্রাণ দিতেও হয়েছিল। জেভিপি দলের প্রতিষ্ঠাতা রোহানা উইজেবিরা-সহ প্রায় ৬০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে দল সহিংসতার পথ ছেড়ে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা দখলের পথে এগিয়ে চলে। এবার সেই পথেই দিশানায়েকের জয় হল।
শ্রীলঙ্কায় নবনির্বাচিত বামপন্থি প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে ভারতের কট্টর সমালোচক হিসেবে পরিচিত। তাঁর জেভিপি দলকে শ্রীলঙ্কায় চীনপন্থি হিসেবেই দেখা হয়। সেই দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে নেপালের পর শ্রীলঙ্কায় বামদের আগমন ঘটল। অন্যদিকে মালদ্বীপেও ড. মোহাম্মদ মুইজ্জু কট্টর ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশেও ঘনিষ্ঠ মিত্র আওয়ামী লীগের পতন ঘটেছে। এদিকে শ্রীলঙ্কায় গোতাবায়ার ক্ষমতাচ্যুতির পর রনিল বিক্রমাসিংহের নেতৃত্বে গত দুই বছরের বেশি সময়ে অর্থনৈতিক সংকট থেকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ায় দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কা। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেওয়া ঋণের শর্ত অনুযায়ী কর বাড়ানোসহ নানা পদক্ষেপ নেয় সদ্য বিদায়ী সরকার। এর চাপ এসে পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর। এই অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে উত্তরণের আশায় অনুরা কুমারা দিশানায়েকেকে মানুষ ভোট দিয়েছেন। একদিকে আইএমএফের কঠিন শর্ত, অন্যদিকে জনজীবনের সংকট। এই সংকট মোকাবিলা করে অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাই হবে আগামীতে তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।