কলকাতায় ইলেকট্রিক ট্রাম চালু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই খুব দ্রুত শহরের পরিবহণ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হয়ে উঠেছিল। গত শতকের আশির দশক পর্যন্ত ট্রামই ছিল কলকাতার পরিবহণ ব্যবস্থার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। শহরের ডিপোগুলি থেকে খুব ভোরে ট্রাম চালু হত। তখন ট্রামের দ্বিতীয শ্রেণীতে সবজি, ফল ও মাছ বিক্রেতাদের ভিড় উপচে পড়ত। মফঃস্বল থেকে ট্রেনে এসে তাঁরা ট্রাম ধরে শহরের বিভিন্ন বাজারে পৌঁছতেন। এরপর ডালহৌসি কিংবা অফিস পাড়ার নিত্যযাত্রী এবং হাওড়া ও শিয়ালদহের ট্রেন যাত্রীদের বেশিরভাগই ট্রামের প্রথম শ্রেণীর কামরায় উঠতেন। আসলে সেই সময় সরকারি ও বেসরকারি বাস ছিল হাতেগোনা। তাছাড়া শহরের অনেকাংশ জুড়েই ছিল ট্রাম লাইনের একচেটিয়া আধিপত্য।
শহরের ট্রাম চলাচলের উপর প্রথম আঘাত নামে আশির দশকে যখন উত্তর-দক্ষিণ মেট্রো করিডোরের কাজ শুরু হয়। শহরের অফিস পাড়া ডালহৌসি থেকে দক্ষিণ কলকাতা অবধি বিস্তৃত ১২ কিমি ট্রাম রাস্তা সাময়িক ভাবে বন্ধ হয়। যদিও পরবর্তীতে সেই লাইন আর কোনওদিনও জোড়া লাগেনি। এর পর ট্রাম কোম্পানি বাস পরিষেবা চালু করে এবং তাতে সামান্য হলেও লাভের মুখ দেখতে পায়। হয়ত তারপরই ট্রাম চালাতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তবে শহরের বুক থেকে ট্রাম লাইন তুলে দেওয়ার জন্যে কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের ভূমিকাও যথেষ্ট। দিনের পর দিন ট্রামের জন্যে যানজট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে- এই অভিযোগ তুলেছেন ট্রাফিক আধিকারীকরা। তাদের অভিযোগ এবং অজুহাত দুয়ের সম্মিলিত সুপারিশে শেষ পর্যন্ত শহরের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রাম লাইন বন্ধ হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত, গত শতকের নয়ের দশকের গোড়ায় তৎকালীন পরিবহণ মন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তী বলেছিলেন, “ট্রাম একদিন স্বাভাবিক নিয়মে মারা যাবে”। কিন্তু শতাব্দী উত্তীর্ণ পরিবেশবান্ধব যানটিকে তখন ভেন্টিলেশন থেকে ফিরিয়ে আনতে ট্রাম কোম্পানির আধিকারিকরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। বেশ কযেকটি শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাম কয়েকটি রুটে নামানো হয়। বেশ কয়েকটি পুরোনো ট্রামের ভিতরকার খোলনলচে পাল্টে নতুন করে সাজানো হয় যাতে বিবাহ বা জন্মদিনের অনুষ্ঠান কিংবা নিছকই অফিস বা বন্ধুদের আমোদ অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া যায়। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করে বেশ কয়েকটি বন্ধ হয়ে যাওয়া রুট ফের চালু করারও চেষ্টা করেন ট্রাম কোম্পানির আধিকারিকরা। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, পুরনো ঐতিহ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগিয়ে ২০১৮ সালে নোনাপুকুর ট্রাম ডিপো থেকে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ট্রাম চালু হয়েছিল। যা নোনাপুকুর থেকে ধর্মতলা, ধর্মতলা থেকে শ্যামবাজার সারা দিনে ৬ বার চলত। তখন যা হেরিটেজ ট্যুরের জন্যই সাধারণত ব্যবহার করা হত তা পরবর্তীতে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য করা হয়। এবং সেই ট্রমের গতি ছিল ঘন্টায় ৩৫ কিলোমিটার, ভাড়া ছিল উঠলেই কুড়ি টাকা।
কিন্তু কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের মত, ধীরগতি ট্রামের কারণে যানজটের সৃষ্টি হয়। ডিজিটাল যুগে ট্রাম অনুপযুক্ত এবং এর কোনো আবশ্যকতা নেই। প্রশ্ন একটাই, শুধুমাত্র ধীর গতির যান বলেই কি ট্রামের মতো একটি পরিবেশ বান্ধব যান আমরা শহরের রাস্তা থেকে তুলে দিলাম, নাকি গাড়ি কোম্পানীগুলিকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিলাম?