একটি জায়গা পরিত্যক্ত হওয়ার পেছনে নানা কারণ বা ঘটনা থাকে। আমরা জানি যুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল ধ্বংস হয়েছে। অনেক জায়গায় আবার পারমাণবিক বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর ফলে তা বসবাস অযোগ্য হয়ে পড়ে। বিশ্বে এমন অনেক শহর বা জায়গা রয়েছে যেখানে একসময় বহু মানুষের বসতি থাকলেও এখন সেগুলি পরিত্যক্ত। একসময় প্রাণশক্তিতে ভরপুর থাকলেও বর্তমানে শহরগুলিতে শুধুই শূন্যতা, জনমানবহীনতা বিরাজ করছে। এইরকম একটি শহরের কথা বললে প্রথমেই চলে আসে প্রিপায়াতের নাম। সোভিয়েত ইউনিয়ন চেরনোবিল নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপন করলে ১৯৭৯ সালে এটিকে পৃথিবীর নবম নিউক্লিয়ার শহর হিসেবে ধরা হয়। প্রিপায়াত শহরটি ইউক্রেনের উত্তর অঞ্চলে অবস্থিত। ইউক্রেন-বেলারুশ বর্ডারের কাছাকাছি এর অবস্থান।১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত এই শহরের জনসংখ্যা ছিল ৪৯ হাজারের বেশি। কিন্তু ওই দিন বিকেলে চেরনোবিল দুর্ঘটনার পরই শহরটি পরিত্যক্ত ও জনশূন্য হয়ে পড়ে। সরিয়ে নেওয়া হয় সব বাসিন্দাকে।এখন অবশ্য এই শহরে রেডিয়েশন অনেকটাই কমে গিয়েছে এবং অনেক পর্যটক শহরটি দেখতে আসেন।

একসময় এই শহরটিতে ছিল ১৩ হাজারেরও বেশি অ্যাপার্টমেন্ট, ১৫টি প্রাইমারি স্কুল, ১টি হাসপাতাল, ৩৫টি খেলার মাঠ, ১০টি জিম, ১টি রেলওয়ে স্টেশন এবং ১৬৭টি বাস। শহরটি তৈরি হয়েছিল মূলত চেরনোবিল আণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কর্মীদের থাকার জন্য। এ রকম শহর পৃথিবীতে আরও রয়েছে। তবে ‘প্রিপায়াত’ শহরটি সম্ভবত সব থেকে কম দিন ব্যবহৃত হয়েছিল। সরকারিভাবে ‘প্রিপায়াত’কে শহর হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯৭৯ সালে। কিন্তু ২৬ এপ্রিল ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল আনুবিক চুল্লিতে দুর্ঘটনা ঘটার পর এখানে মানুষ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তখন ২ দিনের মধ্যে সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো একটি শহর ভূতের শহরে পরিণত হয়। আর সেই থেকে সেখানে নেই কোনো জনমানব।পারমানবিক বিস্ফোরণের কারণে মানুষের জন্যও ওই স্থানটি একেবারেই অনুপযোগী। তাই পৃথিবীর ইতিহাসে ‘প্রিপায়াত’ শহরটি ভবিষ্যতে হয়তো আজীবন ভূতের শহর হিসেবেই পরিগণিত হবে।

কেমন আছে চেরনোবিল তা জানতে সেখানে সশরীরে কয়েক বছর পর গিয়েছিলেন ফটোগ্রাফার ডেভিড ম্যাকমিলান। ডেভিড যখন প্রিপায়াত শহরে পৌঁছান, তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে কোনো ধরনের বাধা আসতে পারে। চেরনোবিল এলাকায় পৌঁছালেও বিস্ফোরিত এলাকার আশপাশের এক হাজার স্কয়ার মাইলের ভেতর তিনি প্রবেশ করতে পারছিলেন না। কারণ সেখানে প্রবেশ নিয়ে তখনো নিষেধাজ্ঞা চলছিল। তিনি শুধু এমন কাউকে খুঁজে পেতে চাইছিলেন যিনি কি না তাকে বিস্ফোরিত এলাকার ভেতর প্রবেশ করিয়ে জায়গাটা পুরো দেখাতে পারবেন। তিনি চেরনোবিল এলাকায় গিয়ে পরিত্যক্ত ভবন, খেলার মাঠের বড় বড় ঘাস, পড়ে থাকা যানবাহনের অসংখ্য ছবি তোলেন। সেইসব ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর, অনেকেই জায়গাটি সম্পর্কে নতুন করে আগ্রহী হন। কানাডিয়ান এই ফটোগ্রাফার ডেভিড ম্যাকমিলান এই জায়গায় ২০ বারেরও বেশি এসেছেন শুধু ভিন্ন ভিন্ন সময়ের ছবি তুলতে। চেরনোবিলে তোলা ২০০ ছবি নিয়ে তিনি একটি বই প্রকাশ করেছিলেন `Growth and Decay : Pripyat and the Chernobyl Exclusion Zone’ নামে। বিস্ফোরণের পর থেকে একরকম মনুষ্যস্পর্শবিহীন থেকে, ভৌতিক পরিবেশের এ এলাকাটি কীভাবে প্রকৃতির নিজস্ব ছোঁয়ায় সবুজ হয়ে উঠেছে তার বর্ণনা আছে এই বইয়ে।

ডেভিড নানা ধরনের মানুষের ছবিও তুলেছেন। যার মধ্যে আছে ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিক, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের বিকিরণ পরীক্ষার জন্য বন্যপ্রাণী শিকার করতে আসা বিজ্ঞানী। তাঁর তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, এই এলাকায় এক নারী এসেছেন তার পূর্বপুরুষদের কবর পরিষ্কার করতে। ডেভিড এখন ৭০ একজন বৃদ্ধ মানুষ। তাঁর ধারণা এতদিনে তার শরীর এই পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। তিনি মাসের প্রায় পুরো সময়ই এখন চেরনোবিলে কাটান। তার একজন গাইডের কিছুদিন আগে লিম্ফোমা (ইমিউন সিস্টেমে ক্যানসার) ধরা পড়লে তিনি ইউক্রেন থেকে কানাডায় চলে যান। তবু ডেভিড বিশ্বাস করতে চান না এই রোগের পেছনে রেডিয়েশন দায়ী। যুদ্ধের আগে পর্যন্ত চেরনোবিলে অনেক দর্শনার্থী আসতেন। ইউক্রেনের রাজধানী কিভ থেকে বাসে উঠলে একদিনেই যাওয়া-আসা করা যায়। এই এলাকার আশপাশে তখন বেশ কিছু পরিবার থাকা শুরু করে। সবকিছু ছাপিয়ে ডেভিডের ভীষণ পছন্দের ছিল ওই ভুতুড়ে, ভঙ্গুর, নতুন করে গড়ে ওঠা চেরনোবিল।