গ্রামের সবাই মাছ ধরতেন। সেটাই চিল ওঁদের জীবিকা। কিন্তু ওঁরা যেখানে মাছ ধরতেন, সেখানকার জল একদিন শুকিয়ে যেতে শুরু করে আর মাছও হারিয়ে যায়। মধ্য এশিয়ার অ্যারাল সাগরের গল্প এটাই। সাগর বলা হলেও একে পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম হৃদ বলে ধরা হত। গত পাঁচ দশকে ষাটহাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তন আর প্রায় ৪০ মিটার গভীরের হৃদটি স্রেফ আকাশে মিলিয়ে যায়।এখন সেখানে ধু ধু মরুভূমি। হ্রদের চিহ্ন হিসাবে শুধুমাত্র ১০% আয়তনের একটি জলাধার রয়ে গিয়েছে।

এই ঘটনাকে জলবায়ু পরিবর্তনে এই শতকের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় বলে ধরা হয়। বিজ্ঞানীদের অভিমত, যে নদীগুলি থেকে এই হ্রদে জল আসত, সেগুলির মুখ আগেকার সোভিয়েত রাশিয়া (তখনও উজবেকিস্তান তৈরি হয়নি) সেচ প্রকল্পের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর প্রথম সঙ্কট দেখা যায় আরল সাগরে। কৃষিজমি তৈরির জন্য সির দারিয়া এবং আমু দারিয়া নামের ওই নদীগুলোর মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার পর জলের প্রবাহ কমে যায়। অবৈজ্ঞানিক ভাবে খাল কাটার কারণে আরল সাগরের জলের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। এই দাবি বিজ্ঞানীদের। অন্য দিকে, বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবও পড়ে আরল সাগরে। মূলত এই দুই কারণে কয়েক দশকেই বাষ্পীভূত হয়ে যায় আরল সাগরের জল। হ্রদটির কিছু অংশ বাঁচানোর শেষ প্রচেষ্টা হিসাবে কাজাখস্তান আরল সাগরের উত্তর এবং দক্ষিণ অংশের মধ্যে একটি বাঁধ তৈরি করে। এখন হ্রদের সামান্য অংশই অবশিষ্ট রয়েছে।

আগল সাগর শুকিয়ে যাওয়ায় কারণে সমস্যার মুখে পড়েছেন উজবেকিস্তানের বাসিন্দারা। একসময় রাশিয়া এবং কাজাখস্তানের মধ্যে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল আরল। এছাড়াও হ্রদ শুকিয়ে যাওয়ায় প্রচণ্ড জলকষ্ট দেখা গিয়েছে সেই ভূখণ্ডে। মানুষের শরীরে বাসা বেঁধেছে রোগ। মৎস্যজীবীরাও পুরনো পেশা ছেড়ে নতুন কাজের চেষ্টা করে চলেছেন বিগত এক দশক ধরে। রাষ্ট্রপুঞ্জের মতে আরল সাগর শুকিয়ে যাওয়া ২১ শতকের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয়। বর্তমানে আরল সাগরের যেটুকু অংশ অবশিষ্ট রয়েছে, তা সংরক্ষিত করে উজবেকিস্তানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী। তবে এই হ্রদকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব বলেই মত বিজ্ঞানী মহলের একাংশের।

আরাল সাগর শুকিয়ে যাওয়ার কারণে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আরাল সাগর এলাকার অধিবাসীরা। কারণ তাদের অধিকাংশ নাগরিকের আয়ের প্রধান উৎস ছিল এই হ্রদটি। তাই সাধারণ জনগণের আর্থ-সামাজিক কাঠামো ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। জল শুকিয়ে গেলেও লবণ থেকে যায়। বিপর্যয়ের কারণে পূর্বের আরাল সাগর উপকূলে ঘন লবণের স্তূপের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সেখানকার মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। লবণাক্ত পরিবেশ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফলে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ মহামারী হিসেবে দেখা দেয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৫০ বছরের মাথায় আরাল সাগরে লবণের ঘনত্ব বেড়ে লিটারপ্রতি গড়ে ১০০ গ্রাম হয়ে যায়। ১৯৯০ সালের দিকে আরাল সাগর এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। আরাল সাগরতীরে গড়ে ওঠা মৎস্যশিল্পের চূড়ান্ত পতন ঘটে। পরিবেশবিদরা আরাল সাগরের পরিণতি দেখে চিন্তায় পড়ে যান। বিশ্ব উষ্ণায়নের হুমকির সঙ্গে লড়াই করতে থাকা মানবজাতির জন্য আরাল সাগর বিপর্যয় এক অপূরণীয় ক্ষতি।

১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে আরাল সাগর নতুন রাষ্ট্র কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের অধীনে চলে আসে। কিন্তু সাগর বলতে আমরা যা বুঝি, তার কোনো অস্তিত্ব তখন নেই। মাত্র ১০ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে জল অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু আরাল সাগরের বিপর্যয়ের কারণে পুরো অঞ্চলের আবহাওয়ার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই দুই দেশের নেতারা একত্রিত হয়ে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হাতে নেন। লম্বা খাল খনন করে দক্ষিণে সাগর থেকে জল আনার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রযুক্তিগত ত্রুটি এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে কোটি কোটি ডলার লোকসান হয়। শেষ পর্যন্ত পুরো প্রকল্প বাতিল করে দেওয়া হয়।

আরাল সাগর বিপর্যয় বর্তমান পৃথিবীর জন্য একটি সতর্কবার্তা। স্বার্থপর মানুষের ভুল পদক্ষেপের জন্য পৃথিবীর বুক থেকে পুরো একটি হ্রদ বিলীন হয়ে গেছে। স্বার্থান্ধ সিদ্ধান্তের দরুন হয়ত এভাবেই সব জল শুকিয়ে যাবে। ইংরেজি ভাষায় একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে- ‘Prevention is better than cure’। গোটা বিশ্ব একসঙ্গে কাজ না করলে ধীরে ধীরে পুরো পৃথিবী ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে। এজন্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আমাদের উচিত পরিবেশবান্ধব প্রকল্প হাতে নিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলা।