পৃথিবীতে ২০৭টিরও বেশি দেশ আছে। আর দেশ থাকলে সেই দেশের রাজধানী থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ রাজধানী হল একটি দেশের প্রাণকেন্দ্র। রাজরাজড়াদের সময় নতুন নতুন শহর, রাজধানী গড়ে তোলার ঘটনা আকছারই ঘটত। আবার সুবিধামতো দেশের রাজা পাল্টে নিতেন রাজধানী। আধুনিক কালেও রাজধানী বদলের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। যেমন যানজটে নাকাল রাজধানীবাসীকে মুক্তি দিতে রাজধানী পাল্টে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটির সরকার ঘোষণা করে, জাকার্তার বদলে তারা যে নতুন রাজধানী তৈরি করতে যাচ্ছে, তার নাম হবে ‘নুসানতারা’। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারও ২০০৫ সালে ইয়াঙ্গুন (আগের রেঙ্গুন) থেকে রাজধানী সরিয়ে নেপিডোতে স্থানান্তর করেছে। আবার এমন অনেক দেশ রয়েছে, যাদের একটি নয়, রয়েছে দুটি করে রাজধানী। একাধিক রাজধানীর দেশগুলির একটি হল শ্রীলঙ্কা। কলম্বো দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী আর শ্রী জয়াবর্ধনেপুরা কোট্টে প্রশাসনিক রাজধানী।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরটিই হয়ে থাকে সেই দেশের রাজধানী। কিন্তু বিশ্বে এমন দেশও আছে, যার কোনো রাজধানী নেই! যেমন—নাউরু। এটিই পৃথিবীর একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ, যে দেশের কোনো রাজধানী নেই। শুধু তাই নয়, দেশটির নিজস্ব কোনো সেনাবাহিনীও নেই। নাউরু পৃথিবীর তৃতীয় ক্ষুদ্রতম দেশ। দেশটিকে একসময় ‘প্লেজেন্ট আইল্যান্ড’ নামেও ডাকা হত। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র নাউরু ওশেনিয়ায় অবস্থিত। নাউরুর রাষ্ট্রীয় নাম ‘নাউরু প্রজাতন্ত্র’। ভ্যাটিক্যান সিটির পর নাউরুই হচ্ছে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র। অর্থাৎ নাউরু হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র। জার্মানি উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে দ্বীপটি দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান এটিকে দখল করে। ১৯৬৮ সালের ৩১ জানুয়ারি দেশটি জাপানের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। নাউরুর ৯৭ শতাংশ পুরুষ এবং ৯৩ শতাংশ নারী স্থূলতার শিকার। মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ নাগরিকের রয়েছে টাইপ-২ ডায়াবেটিস। কিডনি বিকল এবং হৃদরোগ সেখানে খুবই স্বাভাবিক। সেই সঙ্গে নাউরুর ৯০ শতাংশ নাগরিকই বেকার। তবে দেশটির শিক্ষার হার প্রায় ৯৬ শতাংশ।
অস্ট্রেলিয়া থেকে আকাশপথে নাউরুতে যেতে লাগে পাঁচ ঘণ্টা। দেশটির মোট আয়তন মাত্র ২১ বর্গকিলোমিটার। ২০২৩ সালের হিসাবে এর মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৪ হাজার ৪০০। ১৯৭০-৮০-র দশকে দেশটিতে ছিল ফসফেট খনির রমরমা ব্যবসা। বর্তমানে নাউরুর অর্থনীতির মূল উৎস হলো ফসফেট মাইনিং, অফসোর ব্যাংকিং, মৎস্য শিকার ও বৈদেশিক সহায়তা। বর্তমানে দেশটির মাথাপিছু আয় ১৭ হাজার ৮৭০ ডলার। নাউরুর সরকারি মুদ্রা অস্ট্রেলিয়ান ডলার। দেশটির জাতীয় ভাষা নাউরুয়ান। তবে ব্যবসা ও সরকারি দাপ্তরিক কাজে ইংরেজির চল আছে। স্বীকৃত রাজধানী না থাকলেও নাউরুর সরকারি দপ্তরগুলো অবস্থিত ইয়ারেন জেলায়। দেশটির বেশির ভাগ মানুষ খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। কেউ কেউ দাবি করেন নাউরুর রাজধানী ‘ইয়েরেন’। এরকম দাবি করার যুক্তি হচ্ছে, দেশটির বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ অট্টালিকা, পার্লামেন্ট ভবন, দূতাবাস ইত্যাদি ইয়েরেনে অবস্থিত। প্রকৃতপক্ষে দেশটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত ও স্বীকৃত কোনো রাজধানী নেই। এখানকার আদি বাসিন্দারা মাইক্রোনেশীয় ও পলিনেশীয় জাতির মানুষ।
নব্বইয়ের দশকে নাউরু কালো টাকা সাদা করার আখড়াতে পরিণত হয়। দেশটি ২০০১ সাল থেকে অস্ট্রেলিয়া সরকারের কাছ থেকে অনুদান গ্রহণ করছে। বিনিময়ে অস্ট্রেলিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে নাউরু। দেশটি স্বাধীনতা অর্জনের সময় পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ ছিল। কিন্তু বর্তমানে নাউরুতে বেকারত্ব বেড়ে গেছে, অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট নাজুক। সামুদ্রিক পাখির মল থেকে উদ্ভূত খনিজ তাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ১৯০৭ সাল থেকে অর্থনীতির প্রধান আয় আসে ফসফেট খনিজ আকরিকের মাধ্যমে, যা বর্তমানে শেষ হয়ে এসেছে। ফলে সেখানে দেখা দিয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়। দ্বীপের সম্পদ রক্ষার্থে গঠিত তহবিল অব্যবস্থাপনার জন্য সেখানে অর্থনৈতিক ধস নামে। নেই রাজধানী। তার উপর জনসংখ্যাও কম। তা সত্ত্বেও নাউরু কমনওয়েলথ এবং অলিম্পির গেমসে প্রতিনিধিত্ব করে থাকে।