চার
ক্ষুদিরামের সঙ্গে কথাবার্তা সেরে দুজনেই স্নানের জন্য উদ্যোগী হলেন। বিপ্লবীয়ানার গোপন সামগ্ৰী ও আগ্নেয়াস্ত্র রেখে চললেন স্নানের ঘাটে। বিভূতির কাছে ছিল একটি টেক ঘড়ি ও একটি খোকা। প্রফুল্ল চাকীর কাছে ছিল শুধুমাত্র একটি খোকা। দুজনেরই পরনে ছিল মোটা ধুতি, গায়ে মোটা গেঞ্জি ও তার উপরে ছিল সূতির সাধারণ কোট। সেই সব ময়লা পোশাকগুলো প্রথমে ধুয়ে নিলেন। ধূলো বালি আর ময়লা তুলতে ভালো করে সাবান মেখে স্নান সেরে নিলেন দুজনে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে জামাকাপড় শুকিয়ে নিয়ে ছাত্র ভান্ডার থেকে দুজনেই গেলেন খাবারের জন্য ভাতের হোটেলে।
মায়ের নামে শপথ নিয়ে এক পোশাকে বেরিয়ে গেছেন এক অনিশ্চিত যাত্রায়। যেখানে প্রতিটি মূহুর্ত জীবনকে বাজি রেখে চলতে হয়। এই আগুন ঝরে পড়ার বয়সে কি অনমনীয় জিদ আর লক্ষ্য পূরনের অঙ্গীকারের ইতিহাস, আত্মোপলব্ধির কথা পড়লে শিহরণ জাগে দেহে ও মনে। কাঁটা দিয়ে ওঠে সারা শরীর। অরবিন্দ, বিভূতিভূষণ, প্রফুল্ল, ক্ষুদিরাম, বারীণ, সত্যেন, হেমচন্দ্র, নরেন্দ্রনাথ ( এম.এন.রায় ), কালীকৃষ্ণ, প্রফুল্ল চক্রবর্তী, হরেন্দ্রকৃষ্ণ, কানাইলাল, উল্লাসকর-সহ অগণিত আগুন পাখিদের সমবেত প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ ভারতের ভিত কেঁপে উঠেছিল। দিশেহারা হয়ে উঠেছিল ইংরেজ বাহিনি। বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্বে অন্তত দুটি বিশেষ রেজিমেন্ট গঠন করে। এবার কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে মরীয়া প্রশাসন। কলকাতা পুলিশ বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে প্রধান পদে ( কমিশনার ) বসানো হলো শার্দুলের চেয়েও ভয়ঙ্কর কুখ্যাত অফিসার চার্লস অগাস্টাস টেগার্টকে। তার পুলিশিং ও ‘কুম্বিং অপারেশন’ ছিল ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময়। ভারতীয় বিশেষ করে বাঙলার চরমপন্থী বিপ্লবকে সন্ত্রাসবাদ ও ধ্বংসাত্মক বলে কুখ্যাতি করেছেন ( terrorism in India,1943) তার ঐতিহাসিক প্রতিবেদনে। সমসাময়িক পুলিশ রিপোর্ট আর প্রতিবেদনগুলো পড়লেই জানা যাবে সেই সব দিনের আগুন ঝরানো ইতিহাস। টেগার্টের মূল লক্ষ্যই ছিল বিপ্লববাদ যাতে দানা বাঁধতে না পারে। ছোট ছোট অভিযান চালানো, গোয়েন্দা নিয়োগ করে গুপ্ত সমিতির গোপন খবর বের করে আনার কৌশল নিলেন এই কুখ্যাত কমিশনার। খানা তল্লাশির প্রস্তুতি নিলেন নিজের নেতৃত্বে। উল্টোদিকে অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর সহ বিভিন্ন মত ও পথের সংগঠনগুলোর মূল লক্ষ্য হয়ে উঠলো ব্রিটিশ নিধন যজ্ঞ। চারিদিক থেকে এমনকি বাঙলা থেকে বরোদা এমনকি বিদেশের মাটিতেও গড়ে উঠলো গোপন নেটওয়ার্ক। একে সর্বাত্মক করে তুলতে বিষ্ফোরক সহ অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগবিধি ও প্রশিক্ষণের জন্য হেমচন্দ্র কে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। বরোদা’য় যতীন্দ্রনাথ ও বারীন্দ্রনাথকে পাঠানো হয়েছিল বিপ্লববাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিতে। সমস্ত আঁটঘাট বেঁধেই অরবিন্দ নেমে গেলেন অগ্নিপথের দিশারী হয়ে। কোলকাতার বুকেই সংগঠিত হলেন দলে দলে। অখন্ড বাঙলার বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের আঁচ করতে পারেনি ব্রিটিশ প্রশাসকগণ। কিভাবে কিম্বা কাদের কাছে বিপ্লববাদের পাঠ নিতেন বিপ্লবীদল? বোর্ডিং, মেস থেকে মুরারীপুকুরের আখড়ার ইতিহাসের কথায় পরে আসছি। প্রস্তুতির ইতিহাস জুড়ে আছে সর্বশক্তিময়ী মা, শ্রীমৎ ভাগবত গীতা ও বন্দেমাতরম মন্ত্রের জোরালো প্রভাব। তারপর আছে শৃঙ্খলা, শরীর চর্চা, খেলাধুলা, আত্মরক্ষা ও প্রত্যাঘাতের জন্য অস্ত্র প্রশিক্ষণের ইতিহাস। সেই কারণেই মুরারীপুকুর হয়ে উঠেছিল বিপ্লববাদের আঁতুড়ঘর।
এদিকে বিভূতিভূষণ ও সহযোদ্ধা প্রফুল্ল খাওয়া দাওয়া করে ছাত্র ভান্ডারে সমস্ত গোপন বৈঠক সেরে রওনা হলেন মেদিনীপুর স্টেশনের পথে। কোলকাতাগামী গুমো প্যাসেঞ্জারের টিকিট কেটে নিলেন। ট্রেন আসার সূচনা হয়নি এখনো। দুজনেই ইতস্তত পায়চারি করছেন প্লাটফর্মে। হঠাৎ তাঁদের নজরে পড়ে গেল একটি সরকারি পোস্টার। দেওয়ালে সাঁটা পোস্টারে লেখা আছে- “গোয়ালন্দে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট অ্যালেন সাহেবকে কেহ বা কাহারা গুলি করিয়া মারিয়াছে। যে বা যাহারা অপরাধীর সন্ধান দিতে পারিবে তাহাদিগকে সরকার ১০ হাজার টাকা পুরস্কার দিবে। “এই সবে নজর না দেওয়ার জন্য বিভূতিভূষণকে প্রফুল্ল টেনে সরিয়ে দেন। এগিয়ে আসেন ট্রেন ধরার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে গুমো প্যাসেঞ্জার এসে ঢুকলো স্টেশনে। দুজনেই উঠে পড়লেন কোলকাতার উদ্দেশ্যে।
(চলবে)