সৃষ্টির পর থেকে এই পৃথিবীতে জন্ম হয়েছে নানা সভ্যতার, জন্ম হয়েছে নানা শহরের। প্রাচীন এসব শহরের কোনো কোনোটি টিকে আছে আজও, হয়েছে আরো উন্নত। আবার কোনো কোনো শহর নানা কারণে হারিয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে। প্রাচীন নগরী আটলান্টিস থেকে রহস্যময় এলডোরাডো, এসব প্রাচীন হারিয়ে যাওয়া সভ্যতাগুলো আজও এদের নিজ নিজ রহস্যময় গল্প নিয়ে মানুষের মনে বেঁচে রয়েছে। আফ্রিকার দুর্গম জঙ্গল থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এসব রহস্যময় লুকানো শহরগুলো সবসময় নানা অভিযাত্রী, নানা পর্যটককে আকর্ষণ করেছে। অনুপ্রাণিত করেছে বহু লেখক, বহু চলচ্চিত্র নির্মাতাকে। এসব শহর নিয়ে লেখা হয়েছে বহু বই, তৈরি হয়েছে বহু সিনেমা।
ইতিহাসে দক্ষিণ আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমিতে পাওয়া একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন শহরের খবর পাওয়া যায় গিলারমো ফারিনী নামে কানাডার এক অন্বেষণকারীর কাছ থেকে। কালাহারির হারিয়ে যাওয়া শহরের কথা বলতে গেলে তাঁর নামই প্রথমে উঠে আসে। তরুণ বয়সে সরু দড়ির উপর দিয়ে নায়াগ্রা ফলস পার হয়ে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। তারপর ফারিনি ছদ্মনাম ধারণ করে দেশে বিদেশে অনুষ্ঠান করে বেড়াতে থাকেন। লন্ডনে আফ্রিকান উপজাতিদের নিয়ে কাজ করার সময় বুশম্যানদের কাছে শোনেন হারিয়ে যাওয়া শহর আর হীরের খনির সেই সব উপকথা। আফ্রিকার দক্ষিণে অভিযান চালিয়ে ১৮৮৫ সালে খুঁজে পান কালাহারির হারিয়ে যাওয়া শহরের ধ্বংসাবশেষ। তিনি হীরের সন্ধানে কালাহারিতে গিয়েছিলেন।
আসলে গিলারমো ফারিনী একজন অভিনেতা যার নাম উইলিয়াম লিওনার্ড হান্ট, নিজের নাম পরিবর্তন করে সাইনর গিলারমো আন্তোনিও ফারিনী নাম নেন। ইউরোপ ফেরার সময়, ফারিনী তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছিলেন।ফারিনির বর্ণনা অনুযায়ী একটির উপর আরেকটি পাথর সাজিয়ে বিশাল এই শহরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ভূমিকম্পের পরে চীনের মহাপ্রাচীর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলে যেরকম হয়, শহরটির অবস্থা অনেকটা সেরকম। শহরটির ধ্বংসস্তূপের কিছু অংশ মাটির নিচে তলিয়ে গিয়েছে। ধ্বংসস্তূপের কিছু অংশ খনন করে ছ’মিটার চওড়া একটি পথের সন্ধান পান তিনি। তবে কোনো শিলালিপি বা গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যায় নি। ফারিনির মতে ধ্বংসস্তূপটি হাজার বছর পুরনো কোননো শহরের। শহরটিকে নিয়ে একটি কবিতাও লেখেন তিনি।
বিশ শতকের শুরুতে, ফারিনির পর্যবেক্ষণ দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে এক কিংবদন্তির জন্ম দেয়। কিছু লোক দাবি করেছিলেন যে খালি প্রান্তরে একটি পরিত্যক্ত নৌকা বা একটি পাথর কোয়ারীও দেখেছেন। অন্যরা গ্রেট জিম্বাবুয়ের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির সঙ্গে তুলনা করে এই অজানা সভ্যতার উপস্থিতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন।হারিয়ে যাওয়া শহরটির অনুসন্ধানে মোট পঁচিশটি অভিযান হয়েছিল। তারা ফারিনীর নির্দেশ মতো মরুভূমি অঞ্চলটিকে অতিক্রম করে ফেলেছিল। এফআর পাভার এবং ডব্লু এম বোর্চার্ডস উপিংটন থেকে মরুভূমির বালির সন্ধান করতে বেরিয়েছিলেন, বেশ কয়েকটি ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন। তবে তারা এলাকায় কোনো চিহ্নের সন্ধান করতে ব্যর্থ হন।
এরপরে এ জে ক্লিমেন্ট, পেশায় একজন দন্তচিকিত্সক এবং “দ্য লস্ট সিটি অফ দ্য কালাহারির” সম্পর্কে উত্সাহী হন এবং একটি নতুন তত্ত্ব হাজির করেন। ক্লিমেন্ট দাবি করেছিলেন যে ফারিনির বিবরণ নিয়ে তাঁর অধ্যয়ন ফারিনির গল্পের অসঙ্গতি তুলে ধরেছে। ক্লিমেন্ট এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে ফারিনী দক্ষিণ আফ্রিকার গভীরে চলে গিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি কখনও কলাহারীর হৃদয়ে পৌঁছাননি অথচ তিনি দাবি করেছিলেন যে লস্ট সিটি। ক্লিমেট নামিবিয়ার সীমান্তে কাম্কুয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে রিয়েটফন্টেইন পরিদর্শন করেছিলেন, যেখানে তিনি দেখেন একটি অসাধারণ শৈল গঠন যা এগ্রেল হিলস নামে পরিচিত। জায়গাগুলিতে, শিলাগুলি দেখতে বড় পাথর থেকে নির্মিত দ্বৈত প্রাচীরের মতো। ক্লিমেন্ট ভেবেছিল যে ফারিনী সম্ভবত বর্গাকার বিল্ডিং ব্লকগুলি দিয়ে পাথরগুলিকে বিভ্রান্ত করেছেন।
ফারিনির অ্যাডভেঞ্চারের পর থেকে হারিয়ে যাওয়া শহরটি সন্ধানের জন্য কয়েকশো অভিযান চালানো হয়েছিল, তবে তাদের কোনোটিই সফল হয়নি। অবশ্য, অনেকে আছেন যারা ক্লিমেন্টের প্রাকৃতিক শিলা গঠনের তত্ত্ব সম্পর্কে বিশ্বাসী নন।তবে কালাহারির হারানো শহর সম্পর্কে এখনও অনেকের কৌতূহল রয়েছে এবং সে কারণেই এটির অনুসন্ধান এখনও চলছে। দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তরে, নামিবিয়ার পূর্বে আর প্রায় পুরো বতসোয়ানা জুড়ে কালাহারি মরুভূমির অবস্থান। বুশম্যান আর হটেনটট উপজাতির বসবাস এখানে। তাদের বিশ্বাস, একসময় এই মরুভূমিতে ছিল এক সমৃদ্ধ শহর। যে শহরে শিশুরা খেলা করত হীরের টুকরো দিয়ে।এ শহরটি কেমন ছিল, কারা এটি নির্মাণ করেছিল, কিভাবে ধ্বংস হল- সেসব তথ্য আজ অজানাই রয়ে গেছে। আবার অনেকে প্রশ্ন তোলেন, আদৌ কালাহারিতে কোন শহর ছিল কি? নাকি পাথরগুলো প্রাকৃতিকভাবেই এমন যে এগুলোকে হারিয়ে যাওয়া কোন শহরের ধ্বংসস্তূপ বলে ভ্রম হয়?