গুহাচিত্র ইংরেজিতে কেইভ পেইন্টিংকে প্যারিটাল আর্টও বলা হয়। সেই গুহাচিত্র হল প্রাচীন কোনো গুহার দেওয়াল, ছাদ এমনকি মেঝেতেও প্রাকৃতিক রঙের সাহায্যে আঁকা বা খোদাই করা ছবি। গুহাচিত্রগুলিতে কালো এবং লাল রঙেরই প্রাধান্য। প্রাকৃতিক রং মানে লাল রঙ্গের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে আয়রন অক্সাইড (হেমাটাইট) এবং কালো রঙের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে চারকোল বা ম্যাঙ্গানিজ ডাই অক্সাইড। অন্যদিকে খোদাইয়ের জন্য চকচকে পাথর বা তীক্ষ ধারালো পাথরের টুকরো ব্যবহার করা হয়েছে। সাধারণত গুহাচিত্রকর্মগুলিকে রঙের ওপরে ভিত্তি করে একরঙা ও বহুরঙা দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। একরঙা চিত্রগুলোতে প্রধানত কালো রং আর বহুরঙা চিত্রকর্মগুলোতে প্রাকৃতিক রঙের সংমিশ্রণে দুই বা তিন ধরনের রং ব্যবহৃত হয়েছে। হাজার হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা কীভাবে বেঁচে থাকত তার ধারণা মেলে গুহাচিত্র থেকে। শুরুতে জীবাশ্ম বিশেষজ্ঞদের ধারণা ছিল গুহাচিত্র কেবলই অলংকরণের জন্য করা। কিন্তু না, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সেই ধারণা পালটে দেয়, বোঝা যায় এই চিত্রগুলির সঙ্গে সামাজিক, অতিপ্রাকৃত ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সংযোগ ছিল। আর আনুষ্ঠানিক উদ্দেশ্যেই তৎকালীন ওঝাদের হাতে এই চিত্রকর্মগুলি সৃষ্টি হত। গুহাচিত্রগুলি দেখলে বোঝা যায় হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা কীভাবে বেঁচে থাকত। গুহাচিত্রগুলিতে প্রাণীর অবয়ব থেকে শুরু করে প্রাচীন অধিবাসীদের সামাজিক জীবন, শিকার ও তাদের লোকাচার সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়।
প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের মধ্যে গুহাচিত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও প্রথম কোথায় গুহাচিত্রের কাজ শুরু হয়েছিল সে বিষয়ে আমারা এখনও কোনো সুস্পষ্ট ধারণা করতে পারিনি। একদল ঐতিহাসিকের মত অনুসারে বলা যায়, প্যালিওলিথিক যুগের শুরুর দিকে বিবর্তনের ধারায় ইউরোপে প্রস্তর যুগের এই শিল্পকর্মের কাজ শুরু হয়েছিল। যেখানেই শুরু হোক গুহাচিত্রগুলির বেশিরভাগ চিত্রেই প্রাধান্য পেয়েছে প্রাণীর অবয়ব। গুহাচিত্র কেমন হবে তা নির্ভর করত মূলত শিল্পীর সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও অভিজ্ঞতা এবং গুহার শিলার উপাদান ও পৃষ্ঠতল, আলোর তারতম্য এবং রঙের কী কী কাঁচামাল পাওয়া যাবে এই সবকিছুর উপর। বহুকাল পর্যন্ত স্পেন ও দক্ষিণ ফ্রান্সের গুহাচিত্রকে সবচাইতে পুরোনো গুহাচিত্র হিসেবে ধরা হত। তবে অস্ট্রেলিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার করা ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপে গুহাচিত্রের সন্ধানের পর তাকেই সবচাইতে প্রাচীন বলে ধারনা করেনন বিজ্ঞানীরা। প্রত্নতত্ত্ববিদরাজানান, স্পেনের গুহাচিত্রের সঙ্গে সুলাওয়েসির গুহাচিত্রের অনেকটা মিল আছে। দুটি গুহাচিত্রের বয়সও প্রায় কাছাকাছি। সুলাওয়েসি দ্বীপের যে গুহাচিত্র পাওয়া গিয়েছিল তার কোনোটি ৩৯ হাজার বছর আগের, আবার কোনোটি ৩৫হাজার বছরের পুরোনো বলে জানান গবেষকরা। তাঁরা বলেন, দ্বীপের বাসিন্দারা কমপক্ষে ১৩হাজার বছর ধরে ওইসব চিত্রকর্মের কাজ করেছিলেন।এই চিত্রকলা শুধু শিল্পের দিক থেকে নয়, মানব চিন্তার বিবর্তনেও নতুন দিশা দেখায়।
সুলাওয়েসি দ্বীপের গুহাচিত্রটিতে একটি বন্য শূকর এবং তিনটি মানবাকৃতি যুক্ত চিত্র রয়েছে যা কমপক্ষে ৫১ হাজার বছরের পুরনো। অর্থাৎ এর আগে যে প্রাচীনতম গুহাচিত্র আবিষ্কার করা হয়েছিল এটি তার চেয়েও ৫ হাজার বছরের বেশি পুরনো। অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ম্যাক্সিম ওউবের বলেছেন, এই চিত্রটি মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে আমাদের ধারণা পাল্টে দিতে পারে। এটি গল্প বলার প্রাচীনতম প্রমাণ। সেই সময় মানুষের বিমূর্ত চিন্তা করার ক্ষমতা ছিল, তা এই চিত্রকলায় প্রতিফলিত।ওই চিত্রকর্মটিতে দেখা যায় একটি শূকর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং তার মুখ আংশিক খোলা। তিনটি মানব আকৃতি শূকরটির সঙ্গে রয়েছে, তাদের মধ্যে একটি দুটি বাহু প্রসারিত করে কিছু ধরে আছে, অন্যটি লাঠির মতো কিছু দিয়ে শূকরটির গলা স্পর্শ করছে, এবং তৃতীয়টি পা উঁচু করে শূকরের মাথা স্পর্শ করছে।এই আবিষ্কারের নেতৃত্বে ছিলেন জাকার্তার ন্যাশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন এজেন্সি-র রক আর্ট বিশেষজ্ঞ আদি আগুস ওকতাভিয়ানা। তিনি বলেন, মানুষ সম্ভবত ৫১-৫২ হাজার বছর আগে থেকেই গল্প বলে আসছে। চিত্রকলার মাধ্যমে সেই প্রাচীন গল্প বলার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।এই প্রাচীন চিত্রকলাটিতে মানব চিন্তার বিকাশের প্রতিফলন, যা শিল্প ও বিজ্ঞানের জন্ম দিয়েছে। এর ফলে প্রাচীন যুগের মানব মনের জাগরণ সম্পর্কে নতুন ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
জরিপের কাজ করতে গিয়ে বাসরান বুরহান নামের যে শিক্ষার্থী ওই গুহাচিত্রটি খুঁজে পান, সেই গুহাচিত্রটিতে একইসঙ্গে ওই অঞ্চলে মানুষের বসতি স্থাপনের সবচেয়ে প্রাচীন প্রমাণ হিসেবেও দেখা যেতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার সুলাওয়েসি দ্বীপের লেয়াং তেডোঙ্গে নামের গুহাটি একটি প্রত্যন্ত উপত্যকায় অবস্থিত। যেখানে গ্রীষ্মকাল ছাড়া যাতায়াত করা কার্যত অসাধ্যকর। ১৩৬ সেন্টিমিটার প্রস্থের এবং ৫৪ সেন্টিমিটার উচ্চতার এই বন্য শুকরের ছবিটি আঁকতে গাঢ় লাল মেটে রঞ্জক ব্যবহার করা হয়েছিলো । কেউ বলেন, চিত্রটি দেখে মনে হচ্ছে শুকরটি আরও দুটি বন্য শুকরের মধ্যকার ঝগড়া করছে অথবা দেখছে। বোঝা যায়, এই অঞ্চলের মানুষ প্রায় কয়েক হাজার বছর ধরেই সুলাওয়েসির বন্য শুকর শিকার করত। আর শুকরগুলি এই অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিক যুগের (বিশেষ করে বরফ যুগের) শিল্পকর্মের অন্যতম প্রধান বিষয়বস্তু ছিল। সবথেকে বড় কথা যারা এই চিত্রকর্মটি এঁকেছে তাদের চিন্তাভাবনা, জীবনধরণ অত্যন্ত আধুনিক ছিল। পাশাপাশি ছবি আঁকার জন্য প্রয়োজনীয় সক্ষমতা এবং উপকরণ তাদের ছিল।