আমরা জানি আমাদের রাজ্যের স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা এমনকি গোটা ব্যবস্থায় সিন্ডিকেট রাজ চালু আছে। সিন্ডিকেটের খবর আমরা আজ পাচ্ছি এমনটা নয়। ছাত্র সংসদ না থাকা, শাসকদলের ছাত্র প্রতিনিধিদের দাদাগিরি, টাকা নিয়ে ভর্তি, অসৎ উপায়ে পরীক্ষার খাতায় নম্বর বাড়িয়ে নেওয়া— এই সব স্বাস্থ্য শিক্ষা দু’জায়গাতেই কমবেশি আছে। যেমন একজনের লেখা থিসিস জোর করে অন্যজনকে দিয়ে দেওয়া। ঠিক যেমনটা ঘটেছে তিলোত্তমার ক্ষেত্রে। ফেল করা ছাত্র ওর থিসিস নিয়ে দিব্যি উতরে গেল, আর প্রাণ দিতে হলো টপার তিলোত্তমাকে। অনার্স নিয়ে পাশ করলেও শাসক দলের অনুগত না হওযয় হাউসস্টাফশিপ না দেওয়া, কথা না শুনলে ফেল করিয়ে দেওয়া। ডাক্তারি পরীক্ষায় এসব হতে পারে কেউ কি আগে ভেবেছিলাম আগে? মেয়েটা প্রাণ দিয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে তাই জানতে পারছি এসব। তারপর দেখা গেল কনভোকেশনে উপাচার্য বা আচার্যের উর্দি গায়ে চাপিয়ে দিব্যি ডিগ্রি বিলোচ্ছে স্বাস্থ্য সিন্ডিকেটের পরিচালক শাসক দলের দাদারা। এ জিনিস এখনো পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখা যায়নি। জানিনা আগামী দিনে কলকাতা যাদবপুর বা রাজ্যের অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশনে তাও দেখতে হবে কি না।
বঙ্গবাসী সরকারি হাসপাতালে এক মহিলা চিকিৎসক খুন-ধর্ষণের তদন্ত চলাকালীন ‘স্বাস্থ্য সিন্ডিকেট’-এর কথা বিস্তারিত জানতে পারলেন। এর আগে বিভিন্ন এলাকায় ইমারতি দ্রব্য সরবরাহে সিন্ডিকেট ব্যবস্থার রমরমার কথা জেনেছিলেন। আর পাঁচটি বিষয়ের মতো সিন্ডিকেটেরও ইতিহাস রয়েছে। শুরুটা রাজারহাট এলাকায় যখন হাজার হাজার বর্গফুট জমিতে উপনগরী তৈরি হচ্ছিল, তখন জমিহারা প্রান্তিক কৃষক-মৎস্যজীবীদের কাছে বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে উঠে এসেছিল সিন্ডিকেট ব্যবসা। সেই সময়ের রাজনৈতিক নেতারাই জমিহারাদের নির্মাণসামগ্রী সরবরাহের পথ বাতলে দিয়েছিলেন। যে পথে প্রথমে কয়েকশো সমবায় তৈরি করে ইমারতি দ্রব্য সরবরাহ শুরু করেছিলেন স্থানীয় যুবকেরা। এক সময় বোঝা যায় সিন্ডিকেট ব্যবসায় কাঁচা টাকা আছে। নজর ঘোরে রাজনীতির কারবারিদের। ফলে তারা সিন্ডিকেটে যুক্ত উঠতি যুবকদের নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন। এতে এক দিকে যেমন টাকার জোগান শুরু হয়, অন্য দিকে বিভিন্ন কাজে, বিশেষত ভোটেও এই যুবকদের কাজে লাগানো শুরু হয়। অভিযোগ পরিবর্তনের জমানায় রাজনীতির কারবারিদের সিন্ডিকেটের উপরে রাশ আলগা হয়ে যায়। সিন্ডিকেটা ব্যবসায় যুক্তরা সরাসরি রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে কেউ কাউন্সিলর হন, কেউ পঞ্চায়েত প্রধান।
রাজ্যবাসী আরও একটি সিন্ডিকেটের কথা জানতে পারে তিলোত্তমা খুন-ধর্ষন তদন্তের সময়। তার আগে রাজ্যবাসী শিক্ষা সিন্ডিকেটের একটি ধারণা পেয়েছিল সঙ্গীত শিল্পী ‘কে কে’ কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে এসে প্রাণ হারালে। ছাত্র সংসদ নেই অথচ তাদের নামেই ৭০ লক্ষ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত সোশালের জন্য বরাদ্দ। এত টাকা দেয় কে, কারা খরচ করে, সেই খরচ কি সরকার নির্ধারিত ব্যয়নীতি মেনে খরচ হয়? প্রশ্ন অনেক কিন্তু তার উত্তর দেবে কে? তিলোত্তমার সুবিচার চেয়ে আমরা দেখলাম অপরাধীরা কতটা পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিকল্পনামাফিক অপরাধ সংগঠিত করেছে, অপরাধের তথ্য প্রমাণ প্রায় পুরোটাই কতখানি সুকৌশলে লোপাট করেছে। এমনকি হাতের ছাপটুকও সব জায়গা থেকে সযত্নে মুছে ফেলেছে। তিলোত্তমার মরদেহ অতি দ্রুততার সঙ্গে দাহ করাটাও তথ্য প্রমাণ লোপাট করার একটি একটি বড় কাজ, সেটিও তৎপরতার সঙ্গেই করা হয়েছে। কিন্তু এত সব বড় বড় কাজ করলো কারা? পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে যারা এ কাজ সাহসের সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে করলো তারাই কী সিন্ডিকেট?
বুঝতে অসুবিধা নেই যে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে নিচের স্তর, তাদের মাথার উপর শাসক দলের ছাতা মেলে ধরা আছে এবং এরা সবাই স্বাস্থ্য সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য। যিনি ময়নাতদন্তের প্রধান দায়িত্বে ছিলেন সেই চিকিৎসক এখন কোথায়, হটাৎ টালা থানার ওসি অসুস্থ হলেন কেন, কেন ডিসি সেন্ট্রাল সাংবাদিক সম্মেলনে ক্রপ করা ছবি দেখাচ্ছেন? এমন বহু প্রশ্ন এক এক করে সামনে আসছে কিন্তু উত্তর দেবে কে? এরা সবাই নানান কায়দায় গোটা তদন্ত প্রক্রিয়াকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে, তদন্ত প্রক্রিয়ার অভিমুখ বদলাতে চেয়েছে। নগরপাল পুলিশের ব্যর্থতা স্বীকার করে পদত্যাগ করতে চেয়েছেন, কিন্তু তাকে তা করতে দেওয়া হয়নি। গোটা ঘটনার জন্য একটি মাথা বা একা সন্দীপ ঘোষ নয়, রয়েছে সিন্ডিকেট, একথা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাস্থ্য-সিন্ডিকেট –যা শাসক দলের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা একটি চক্র যার লক্ষ্য হল বেপরোয়াভাবে ক্ষমতা দখল। সেই ক্ষমতা ভোগ করতে তারা যেমন বেপরোয়া তেমনি দুর্বিনীত এবং উদ্ধত। সিন্ডিকেটের স্বার্থ অর্থনৈতিক একই সঙ্গে রাজনৈতিক। দুর্নীতির পথ ছাড়া এই অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি সম্ভব হয়না, কারণ পরিশ্রম বা সামান্য পরিশ্রমে বিপুল অর্থ ও ক্ষমতা উপার্জন করা যায়না। অর্থ আর ক্ষমতা লোভে বেপরোয়া স্বাস্থ্য-সিন্ডিকেট বেআইনি রাস্তায় হাসপাতালের লাশ পাচার, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রি থেকে শুরু করে মানুষ খুন করতেও দ্বিধাবোধ করে না। আর যেখানেই সিন্ডিকেট রাজ চালু আছে সেখানে পুলিশ থেকে স্বাস্থ্য প্রশাসন বকরার ভাগ পেতে উদগ্রীব। তিলোত্তমা প্রাণ দিয়ে এই সিণ্ডিকেটের ছবিটা মেলে ধরলো কিন্তু আমরা চোখ খুলে কী সেই সিন্ডিকেটের ছবিটাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবো?