এটাই তাদের পঞ্চম এবং শেষ চেষ্টা, সোমবার এমনটাই জানিয়েছিল রাজ্য সরকার। মুখ্যসচিবের ই-মেল পেয়ে ফের মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়িতে গিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা, সঙ্গে সেই পাঁচ দফা দাবি। ভিতরে দু’পক্ষের বৈঠক শুরু হয় সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১২টা, প্রায় ৫ ঘণ্টা পর মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি থেকে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধি দল বেরিয়ে বাসে উঠে চলে যান সবাস্থ্যভবনের ধর্নামঞ্চে। সেখানে গত সাত দিন ধরে তাঁরা ধর্নায় বসে আছেন। এর আগে তাঁরা জানিয়ে দেন, ‘‘কলকাতা পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে সরানো হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের দাবি মেনে স্বাস্থ্য অধিকর্তা এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তাকেও অপসারণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য ভবনের সামনের ধর্নামঞ্চ থেকে জুনিয়র ডাক্তাররা জানান, সরকার তাঁদের আন্দোলনের কাছে ‘নতিস্বীকার’ করেছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস কার্যকর হলে তবেই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হবে।
কার্যত ধর্নার সপ্তম দিন আন্দোলনকারীদের কাছে রাজ্য সরকার নতিস্বীকার করে। তার আগে জুনিয়ার ডাক্তাররা টানা দাঁতে দাঁত চেপে ৩৮ দিন ধরে লড়াই চালিয়ে গিয়েছে রোদ জল মাথায় করে। তাঁরা বলেছেন, এই জয় সাধারণ মানুষ, চিকিৎসক, নার্স— সকলের। এদিকে মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে শুনরা, তাঁরা স্পষ্ট জানান, সুপ্রিম কোর্টের শুনানির পর তাঁরা আলোচনায় বসে সিদ্ধান্ত নেবেন। তাঁরা এও জানান, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে যে দুর্নীতি, ‘থ্রেট কালচার’ তৈরি হয়েছে, তা সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে সরকারের সঙ্গে আলোচনার পথ খোলা থাকবে বলেই মনে হয়। অর্থাৎ, মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের শুনানির দিকে তাঁদের নজর থাকার পাশাপাশি কত দিনে তাঁদের দাবিগুলি বাস্তবায়িত হয়, সে দিকেও নজর থাকবে তাদের।
প্রসঙ্গত, আরজি কর হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসক ধর্ষণ-খুনের ঘটনার প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তাররা স্বাস্থ্য ভবনের সামনে ধর্নায় বসেন। রাজ্য সরকার এবং আন্দোলনকারীদের তরফে সেই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা হয়। কিন্তু উভয় পক্ষ নিজেদের কিছু অবস্থানে অনড় থাকায় বৈঠক আয়োজন হওয়ার পরও ভেস্তে যায়। প্রথম থেকেই ডাক্তারেরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচার দাবি করেন। যে কারণে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি দল নবান্নের সামনে পৌঁছেও ফিরে আসেন সরকার সরাসরি সম্প্রচারে রাজি না হওয়ায়। নবান্নে বৈঠক ভেস্তে যাওয়ার পর গত শনিবার আচমকাই স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি ডাক্তারদের কাজে ফেরার অনুরোধ করেন। আর সে দিনই বিকালে ফের আন্দোলনকারীদের কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে আলোচনার জন্য ডাকা হয়।
বৃষ্টির মধ্যে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে জুনিয়ার ডাক্তাররা পৌঁছেও যান কিন্তু সে দিনও সরাসরি সম্প্রচার এবং বৈঠকের ভিডিয়োগ্রাফির দাবি এবং সরকার নারাজ হওয়ায় আবার ভেস্তে যায় বৈঠক। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে বৃষ্টিতে ভিজে বহুক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন জুনিয়ার ডাক্তারেরা। মমতা তাঁদের আলোচনার জন্য অনুরোধ করেন, চা খাওয়ার জন্য আবেদন করেন। শেষ পর্যন্ত বৈঠক হয়নি। জুনিয়ার ডাক্তারের হতাশ হয়েই কালীঘাট ছেড়ে সল্টলেকের ধর্নামঞ্চে ফেরেন। তবে তার আগে তাঁরা নিজেদের সব শর্ত ছেড়ে অর্থাৎ সরাসরি সম্প্রচার এবং ভিডিয়োগ্রাফি ছাড়াই বৈঠক করতে রাজি হন। কিন্তু সরকারের তরফে তাঁদের বলা হয়, তিন ঘণ্টা মুখ্যমন্ত্রী অপেক্ষা করেছেন আর বৈঠক সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে সিবিআই কর্তব্যে গাফিলতি, প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা, এফআইআর দায়েরে দেরির মতো অভিযোগে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ এবং টালা থানার তৎকালীন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করে। তার আগেই অবশ্য আরজি করের দুর্নীতি মামলায় সিবিআই সন্দীপকে গ্রেফতার করেছিল।
মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে শুনানির বেশিভাগটাই চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিয়ে জোর সওয়াল-জবাব চলে। পাশাপাশি সিবিআই-এর তদন্তের অগ্রগতি নিয়েও সন্তোষ প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ। শুনানিতে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বলেন, সিবিআই তদন্তে রিপোর্ট দেখে আমরা বিচলিত। সিসিটিভি ফুটেজ নিয়েও দীর্ঘ শুনানি চলে। তদন্তকারী সংস্থার দাবি, ২৭ মিনিট ফুটেজ দেওয়া হয়েছে। যদিও কপিল সিব্বল জানান, ৭-৮ ঘন্টার ফুটেজ দেওয়া হয়েছে। কার্যত আরজি কর কাণ্ডের শুনানিতে মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টে প্রশ্নের মুখে পড়ল রাজ্য সরকার। এদিন ডাক্তারদের কর্মবিরতি তুলে নেওয়ার আবেদন জানান রাজ্যের আইনজীবী কপিল সিব্বল। কিন্তু পাল্টা প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের প্রশ্ন, ডাক্তারদের নিরাপত্তায় কী পদক্ষেপ করেছে রাজ্য সরকার। তিনি বলেন, গত শুনানিতে আমরা নির্দেশ দিয়েছিলাম ডাক্তারদের নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে হবে। ওই বিষয়ে রাজ্য কী পদক্ষেপ করেছে? কপিল সিব্বল জানিয়েছেন, অস্থায়ী নিরাপত্তা কর্মীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ করা হচ্ছে নিরাপত্তার দায়িত্বে। তাতে আপত্তি জানায় সুপ্রিম কোর্ট। সরকারি হাসপাতালে অন্তত পুলিশকর্মী রাখা উচিত বলে মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতি। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘অভিযুক্ত একজন সিভিক ভলান্টিয়ার। নিরাপত্তার জন্য সিভিক ভলান্টিয়ারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি তো? নিরাপত্তার অভাব ছিল বলেই তো ওই সিভিক ভলান্টিয়ার সারা হাসপাতাল ঘুরে বেড়িয়েছেন। আবার নিরাপত্তার দায়িত্বে অস্থায়ী কর্মী রাখবেন? আন্দোলনরত ডাক্তারেরা কর্মবিরতি কবে তুলবেন জানতে চাওয়া হলে ডাক্তারদের আইনজীবী বলেন, জুনিয়র ডাক্তারেরা জেনারেল বডি মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেবেন । তার জন্য একটু সময় লাগবে।