জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলনকে অনেকেই বলছেন সাধারণ মানুষের আন্দোলন, কেউ বলছেন এটা গণজাগরণ। কিন্তু সেই গণজাগরণে অভিনবত্ব দিয়েছেন মেয়েরা।লক্ষ্য করলে দেখা যাবে মেয়েরা এই আন্দোলনের প্রথম সারিতে আছেন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে মাথায় রেখেও বলা যায় এই প্রথম অনেক কাল পরে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা ঘর থেকে বেরলেন, প্রতিবাদে আওয়াজ তুললেন “উই ওয়ান্ট জাস্টিস”। অর্থাৎ মেয়েরা সোচ্চারে তাঁদের মত প্রকাশ করলেন। আসলে আরজি কর হাসপাতালের মহিলা ডাক্তার ধর্ষণ-খুনের প্রতিবাদে যে গণআন্দোলন তাকে একভাবে নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে দাঁড়ানোর আন্দোলন বলাই যায়। কারণ, সাধারণভাবে যে মেয়েরা রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে চায় না সেই মেয়েরাও অনুভব করলেন যে কলেজ হাসপাতালের মতো জায়গাতেও যদি একজন মহিলা ডাক্তার ধর্ষিতা এবং খুন হন, তাহলে তাঁর নিজের রাজ্যে এমন কোন জায়গা আছে যেখানে তাঁরা নিরাপদ বোধ করতে পারেন। যদিও ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর গত কয়েক বছরের সমীক্ষা অনুযায়ী এই বাংলা সংখ্যার নিরিখে নারী নির্যাতনে দেশের শীর্ষ স্থানে অবস্থান করছে। পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর বললেই ফুরিয়ে যায়না, বাস্তবে মেয়েদের চলতে ফিরতে প্রতি পদে পদে আশঙ্কা বয়ে বেড়াতে হয়। সমীক্ষা বা সংখ্যা যে কথাই বলুক না কেন, বহুক্ষেত্রেই যে এই নির্যাতনের ঘটনাগুলি চাপা পড়ে যায়- কখনো পরিবার অভিযোগ করতে ভয় পায় বলে, কখনো পুলিশ অভিযোগ নথিবদ্ধ করাতে চায় না বলেও।
এ রাজ্যে গত দশ বছরে একাধিক নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে, প্রায় সব জায়গাতেই সেই অঞ্চলের মানুষ প্রতিবাদ করেছে কিন্তু এতটা ব্যাপকভাবে সেই প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েনি বা এইভাবে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে সেই আন্দোলনে যোগদানও করেননি। প্রশ্ন, সাধারণ মানুষ এইভাবে ঝাপিয়ে পড়লেন কেন? নির্যাতিতা একজন চিকিৎসক বলে? সেই সত্য অস্বীকার করা যেমন যাবে না তেমনি ঘটনাটি ঘটেছে হাসপাতালের নিরাপত্তার বেষ্টনীর মধ্যে। স্বভাবতই মেয়েরা মনে করছেন ঘটনাটি মহিলাদের ক্ষমতায়নের উপরই একটা বড় আঘাত। সমাজে তো মজুত করা সামন্ততান্ত্রিক উপাদানের অভাব নেই। যে কারণে এখনও সামাজিকভাবে নারী ও পুরুষের সমান অবস্থান বহু ক্ষেত্রেই যথাযথভাবে স্বীকৃত নয়। মেয়েদের এগিয়ে চলা, শিক্ষা লাভ করা, সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণ করা এক কথায় পুরুষের সমকক্ষ হয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে এগিয়ে যাওয়ায় বহু সময়েই মেয়েদের হাত পিছন থেকে টেনে ধরা হয়। প্রায়ই মেয়েদের বলে বা শিখিয়ে দেওয়া হয় কিভাবে তারা চলবে, কোন ধরনের পোশাক পরবে, কখন বাইরে বেরোবে এবং ফিরে আসবে। এবং এই খড়ির গণ্ডি টানা হয় রাজনৈতিকভাবেও। আমরা যেমন শুনলাম সরকারি নির্দেশিকা, যেখানে সরাসরি মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে রাতে ডিউটি দিতে নিষেধ করা হল। আবার সরকারি দলের নেতা মন্ত্রীদের মেয়েদের বিরুদ্ধে কুৎসিত ও কদর্য ভাষার মন্তব্যও শুনলাম। কোনো সভ্য দেশের সরকার কি এমন তালিবানি নিষেধ জারি করতে পারে বা প্রস্তাব আকারেও আনতে পারে? আর সেই সব নেতা বা মন্ত্রীরা কোন রাজনৈতিক আদর্শে লালিত পালিত হয়ে কার অনুপ্রেরণায় ওই ধরনের কথা বলতে পারেন? স্পষ্ট বোঝা নিষেধাজ্ঞা বা কদর্য ভাষণের কারণ, যাতে মেয়েরা কখোনই কোনো কর্মক্ষেত্রেই পুরুষের সমকক্ষ না হয়ে দাঁড়াতে পারে। জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণ থেকে রাত দখল ওরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না তাই ফোঁস করছে। আন্দোলনের আরেকটি অভিনবত্ব কোনো ফোঁস-ফাঁশ কর্ণপাত করছে না মেয়েরা।
আমরা দেখেছি রাজ্যের শাসক দলের বিভিন্ন নেতা মন্ত্রীরা অন্য রাজ্যের নারী নিগ্রহের পরিসংখ্যান মাথায় নিয়ে ঘোরেন সেগুলির উল্লেখও করেন। আসলে তারা বোঝাতে চান যে এমন তো ঘটেই থাকে, অতএব মাত্র একটি ঘটনাকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ার কোনও কারণ নেই। অতীতেও তারা নারীনিগ্রহের মতো ঘৃণ্য ঘটনাকে “ছোট ঘটনা” বলেছেন। যে কারণে অধিকাংশ ঘটনায় অপরাধী ধরা পড়েনি, বা পড়লেও সরকারের পক্ষ থেকে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কিন্তু এবার রাজ্যজুড়ে যে প্রতিবাদ, প্রতিরোধের ঢেউ তা ছড়িয়ে গিয়েছে দেশের সর্বত্র এবং পৃথিবীর বিভিন্ন কোণায়। এই আন্দোলন সামগ্রিকভাবে যেমন নারী নিগ্রহের প্রতিবাদী আন্দোলন, তেমনি নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে দাঁড়িয়ে বিশেষ বার্তা দিচ্ছে। কিন্তু কেন মেয়েরা সাংবাদিক সম্মেলনে কথা বলছেন না, কেন জুনিয়ার ডাক্তারদের তরফে শুধুমাত্র ছেলেরাই সাংবাদিকিদের তাঁদের কর্মসুচি, পরবর্তী ধাপগুলি জানাচ্ছেন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েরা যেখানে সারারাত জাগছেন সেখানে কেন তারা সাংবাদিক সম্মেলনে সামনে নেই?