প্রথম পর্ব
২০২২ সাল জুড়ে বিশ্বে ঘটেছে বেশ কিছু রাজনৈতিক ঘটনা, যে সব ঘটনা বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে নতুন রূপ দিয়েছে অন্যদিকে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন বাঁক দেখা গিয়েছে। বছরের শেষ প্রান্তে এসে সেই সব ঘটনাগুলির মধ্যে থেকে বাছাই করা কয়েকটি ঘটনার দিকে ফিরে তাকানো যাক।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ
দুটি দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে বাড়তে অবশেষে ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে বসে। বলা বাহুল্য এই যুদ্ধের ফলে দুই দেশেরই হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একই সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের গত মে মাসের তথ্য অনুযায়ী, আনুমানিক ৮০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ৮ নভেম্বরের মধ্যে ৭৮ লাখ ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এছাড়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে দ্রব্যমূল্যের ধাক্কা, পণ্য সরবরাহ এবং খাদ্য দ্রব্যতে এমন ঘাটতি সৃষ্টি হয় যা সামলাতে গোটা বিশ্বকে অন্য এক লড়াই চালাতে হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কায় জনতা রাজ
বছর তিন ধরে চলা অর্থনৈতিক ডামাডোল চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায় ২০২২ সালে। অপশাসন আর অর্থনৈতিক ভুল পদক্ষেপে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া এবং তাঁর ভাই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের আমলে শ্রীলঙ্কা তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে। স্বাধীনতার পর সে দেশে প্রথম এত বড় বিপর্যয়ের জন্য শ্রীলঙ্কাবাসী গোতাবায়ার ভ্রান্ত অর্থনীতিকেই পুরোপুরি দায়ী করে। দেশটির সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পতনে গণরোষ দেখা দেয়। খাদ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের তীব্র ঘাটতিতে ক্ষুব্ধ জনতা গত জুলাই মাসে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ দখল করে, চারপাশে অগ্নি সংযোগ করে। ক্ষুব্ধ জনতার প্রবল রোষে সেনাবাহিনীর বিশেষ বিমানে চেপে গোপনে দেশ ছাড়েন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া। এরপর রনিল বিক্রমাসিংহে সংসদীয় ভোটে জিতে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হলে দেশটিতে প্রায় ২০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা একটি পরিবারের শাসনের অবসান ঘটে।
শিনজো আবের হত্যা:
চলতি বছরের ৮ জুলাই জাপানের নারা শহরে একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার সময় আচমকা গুলির আঘাতে সে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে মঞ্চের উপরেই লুটিয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর। জাপানে বন্দুক হামলা খুবই বিরল ঘটনা। কারণ, সেখানে অস্ত্র বহন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাছাড়া জাপানে রাজনৈতিক ব্যক্তি হত্যার ঘটনাও খুব একটা দেখা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিনজো আবে ছিলেন সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী। ২০০৬ সালে তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১২ সালে ফের প্রধানমন্ত্রী হন।
ইরানে হিজাব বিদ্রোহ:
ঠিকমতো হিজাব পরেননি বলে পুলিশের মারে মৃত্যু হয় ২২ বছরের কুর্দ তরুণী মাহসা আমিনির। ওই ঘটনার পর থেকেই দেশজুড়ে চলে প্রতিবাদী মিছিল। ব্যাপক ধরপাকড় ও গুলি চালিয়ে হিজাব বিদ্রোহীদের ছত্রভঙ্গ করে ইরান সরকার। স্বৈরশাসকের বিরোধিতায় ইটালির বুকে তৈরি হওয়া ‘বেলা চাও’ গানটি গেয়ে ইরানের রাস্তায় প্রতিবাদ জানায় আরব দুনিয়ার মেয়েরা। হিজাব বিরোধী সেই আন্দোলনে শামিল পুরুষদের একাংশ। তাদের কণ্ঠেও ‘বেলা চাও’। প্রতিবাদের ভিডিও নিয়ে নেটদুনিয়ায় চলে জোর চর্চা। ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন তিনশোর বেশি মানুষ। লাগাতার বিদ্রোহের জেরে অবশেষে হিজাব আইন বদলের ইঙ্গিত দিয়েছে আয়াতোল্লা খামেনেই প্রশাসন। চাপের মুখে হিজাব আইন নিয়ে পর্যালোচনা শুরু করেছে ইরান। শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহের আগুনে সরকার আইন বদলায় কিনা আপাতত সেদিকেই চোখ সারা বিশ্বের।
জিনপিং ফের চিনের প্রেসিডেন্ট :
প্রথা ভেঙে চিনের মসনদে তৃতীয়বারের জন্য বসলেন শি জিনপিং। গত অক্টোবর মাসে শেষ হয় চিনের কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেস। এই কংগ্রেসেই তৃতীয়বারের জন্য সে দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নেওয়া হয় জিনপিংকে। কিন্তু চিনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওকে মিডিয়ার সামনে আসতে না দিয়ে প্রায় জোর করে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। মসনদে বসলেও জিরো কোভিড নীতি, লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছে জিনপিংয়ের। বেজিংয়ের রাজপথে দেখা গিয়েছে ‘বিশ্বাসঘাতক একনায়ক’, ‘আমরা কোভিড পরীক্ষা চাই না, চাই খাবার’, ‘লকডাউন চাই না, চাই স্বাধীনতা’ ইত্যাদি ব্যানার। মনে করা হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত হয়তো ক্ষমতাও হারাতে পারেন তিনি। তার আগে রটে গিয়েছিল তিনি নাকি গৃহবন্দি হয়েছেন। পরে সমস্ত জল্পনার অবসান ঘটিয়ে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
(চলবে)