একবার প্রথম প্রেমে ল্যাং খেয়ে কোন এক একুশে মে’র গুমোট বিষণ্ণ বিকেলে আমাদের অ্যাকাডেমি চত্বরের পাশে সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল এ গিয়েছিলাম। পাঁচ বছরের রোলার কোস্টার অ্যাডোলোসেন্ট প্রেম! হঠাৎ যখন সত্যিই ফুরিয়ে গেল, অঙ্গহানীর মতই ফাঁকা হয়ে গেছিল বুকের একপাশ। অতটা শোক, অতটা আবেগ আর কাকে দেব ঈশ্বর কে ছাড়া? কাঁদছিলাম নীরবে।
ভাবলাম কমবয়সী পেয়ে জ্ঞাণ ঝাড়ছে! (কনভার্ট করার তালে নেই তো!) কিন্ত চার্চ থেকে যখন বেরিয়ে এলাম দেখলাম বাইরের পাতলা সন্ধ্যেটার মত মনটা অদ্ভুৎ হাল্কা হয়ে গেছে। অনেক পরে জেনেছিলাম ঠিক ওই একুশে মে’র গোধূলি লগ্নেই উত্তর কোলকাতার কোন এক পার্কে সৌম্যর সাথে ওর তৎকালীন সিরিয়াস প্রেমেরও চির বিচ্ছেদ হচ্ছিল। তারিখটা মনে আছে কারণ ওই দিনটা আমার জন্মদিন। পরে চমকে উঠেছিলাম ‘হাম দিল দে চুকে সনম’-এ চার্চের ভিতর সলমন আর অজয়-এর সংলাপ শুনে! হুবহু এক কথা! পুরো দেজাভু ফিলিং! জীবনের কিছু ঘটনা সত্যি এক্সপ্লেইন করা যায়না শুধু উপলব্ধি করতে হয়।
যেমন এই বছর দুয়েক আগে, আমার অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার আছে, সাইকোসিস ও হয়ে গেছে দুবার। এমন হয়, কোনো দুশ্চিন্তা মাথায় ঢুকলে তা আর বের হয়না, রেসিং থটস শুরু হয়ে গিয়ে সেটা এমন আউট অফ প্রোপোরশান হয়ে যায় যে এক সময় রিইয়্যালিটি আর ফ্যান্টাসির সীমারেখাটাও মুছে যায় অজান্তে। তো সেরকমই শুরু হয়েছিল কিছুদিন যাবৎ, বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার তৃতীয় সাইকোটিক অ্যাটাক দরজায় কড়া নাড়ছে, এরপর কি হবে জানি, একমাস ধরে চলবে এই বিভীষিকা, মৃত্যুভয়, অলীক অবাস্তব চিন্তা যা আমাকে একমুহুর্ত নিঃশ্বাস ফেলতে দেবেনা, পরিত্রান পেতে আমি চুপিচুপি সুইসাইড করার পেইনলেস পদ্ধতির কথা ভাবতে থাকব, মা, সৌম্য চিন্তায় কালো হয়ে যাবে, কড়া কড়া ঘুমের ওষুধ দেবে ডাক্তার, আরও বাড়াবাড়ি হলে হসপিটালাইজেশন, হাত পা বেঁধে, বেডে ফেলে রাখবে হয়ত।
আমি শুরু করলাম গুরুমন্ত্র জপ করতে। একশো আট বার দূরে থাক আটবার করতেই প্রাণ বেড়িয়ে যাচ্ছে! মাথার ভেতর চাপ চাপ অন্ধকার! উঁচু উঁচু দেওয়াল। নামমন্ত্র স্মরণে আসেনা মন এমনই বিক্ষিপ্ত, চড়া সুরে বাঁধা! হাল ছাড়লামনা, চোখের জলে নরম হয়ে এল বুঝি বন্ধ দরজার জং, আস্তে আস্তে প্রসন্ন হল, লঘু হল আমার ঘরের বাতাস, শারীরিকভাবে টের পেলাম কি একটা কালো ভারী বিষবাষ্প আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল আমাকে আস্তে আস্তে ছেড়ে যাচ্ছে। ক্রাইসিসটা কেটে যাওয়ার পরও কিন্তু জপ করা ছাড়লাম না, দেখলাম এবার ভাল লাগছে! মন আস্তে আস্তে এক অপূর্ব, অনির্বচনীয় আনন্দে, শান্তিতে ভরে উঠছে!
সারারাত জপ করলাম। সে যে কি এক অমৃত সকাল এসেছিল আমার জীবনে কোনদিন ভুলবনা!
যে দিকে তাকাই আলো! আলো! মধুর! মধুর! প্রেমে, লাবণ্যে টইটম্বুর প্রাণ! সমস্ত মুখ সে মানুষের হোক, কুকুর বেড়াল, গাছ পাথর, সমান সজীব, সমান সুন্দর! এমনকি বাড়ির সামনের ডাস্টবিনটা দেখেও আর খারাপ লাগছিল না, জড়, কদর্য, ঘৃণ্য মনে হচ্ছিল না! মনের সেই বিশেষ অবস্থায় কিছুক্ষণের জন্যে হলেও বেশ বুঝেছিলাম “দ্য হোল ইউনিভার্স ইস অ্যালাইভ”!
এই ভাব, তূরীয় অবস্থা অবশ্য বেশীক্ষণ ধরে রাখতে পারিনি। সামান্য মানুষ আমি। তবে সে যাত্রা কোনও ওষুধের সাহায্য ছাড়াই আর একটা সাইকোসিস রুখে দিতে পেরেছিলাম বলে আমার বিশ্বাস। প্রসঙ্গত বলে রাখি আমি কিন্তু বরাবর সাইন্সের দলে। মেন্টাল ইলনেস হোক বা যে কোনও মেডিকেল কন্ডিশন, প্রপার মেডিকেশন কতটা জরুরি আমি নিজে তা জানি। বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বা অভিজ্ঞতার অনেক রকম ব্যাখ্যাই হতে পারে।
যাই হোক আমার ঈশ্বর চিন্তায় ধর্ম, প্রতীক, প্রতিষ্ঠান, প্রথা, রিচুয়াল, কোনও বিশেষ ধরণের জীবনযাপন বা বিধিনিষেধের তেমন প্রাধান্য নেই। ওই জানলাটা অ্যাটলিস্ট আমি পুরোটাই খোলা রাখতে চাই। একদম হাট করে। যাতে যে কোনও খোদার বান্দা সে জেসাস এর ছেলে হোক বা বুদ্ধের, মহম্মদের বা জৈনের যখন আমায় এসে তার পবিত্র ঐশ্বরীক ঊপলব্ধির কথামৃত শোনাবে আমার মন সন্দেহে সংকুচিত হয়ে সে আনন্দরসে বঞ্চিত না হয়। আমি একই রকম মন দিয়ে শুনব পাগান, উইকানদের ক্লিনসিং রিচুয়াল, কিভাবে ওরা নেগেটিভ এনার্জি তাড়ায় আর চাঁদপুজো করে, শুনবো আমার রান্নার মেয়ে দূর্গার কাছে সাবিত্রীব্রতর খুঁটিনাটি, পড়ব আদিবাসীদের বনবিবি, ওলাইচন্ডী পুজোর ইতিহাস। কীর্তন, ভজন, সুফিগান সবরসেই ডুবকি লাগাব লাগাতার!
ইমেজ বা পারসেপসানের ফাঁদে বন্দি না হয়ে যেই শোনাতে আসবে তাঁর দুটো কথা শুনবো মন দিয়ে নিজেরই তাগিদে। সে গৃহী হোক, যোগী হোক,পাগল হোক, মদ্যপ হোক, জুয়ারি হোক, অরি হোক মিত্র হোক!
কারণ দুধ আর জলের থেকে শুধু দুধটুকু নিতে পারলে আখেড়ে তো আমারই লাভ! তাছাড়া হাতেগোণা মহাপুরুষ ছাড়া আমরা সবাই পাপে তাপে সমস্যায় নিমজ্জিত হয়েই তাঁকে স্মরণ করি প্রথমে,হাত বাড়াই তাঁর দিকে (অথবা হয়ত আমাদের নিজদের ভিতরেই যে আলোর উৎস আছে, অমৃতের উৎস আছে তার দিকে)! তখন পরশ পাই প্রাণে করুণাময়ের! ঊপলব্ধি যদি ক্ষনিকেরও হয় তবু তা অমূল্য, সারাজীবন সঙ্গে থাকে সেই করুণামৃত, সময়মত আবার আমাদের টেনে নিয়ে যায় তাঁর দিকে। তাই কারুর অভিজ্ঞতাই ফ্যালনা না, আমরা সবাই তাঁর মধ্যে আছি, তিনি আমাদের সবার মধ্যে। একটা সংস্কৃত শ্লোক দিয়ে শেষ করতে পারতাম কিন্তু ওই যে আমার বিশ্বাস অনুযায়ী ঈশ্বর বলতে আমি যা বুঝি তিনি কোনও বিশেষ ভাষাতেও আবদ্ধ নন।