‘জয় জয় দেবী, চরাচর সারে কুচযুগশোভিত…’ মাঘের বসন্তপঞ্চমীতে এই মন্ত্র উচ্চারিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। বাঙালির রূপকল্পে দেবী সরস্বতী শ্বেত শাড়ি পরিহিতা, হাতে বীণা, সঙ্গে বাহন রাজহংস। পুরাণের রূপকল্পনাতেও সরস্বতী শ্বেতবসনা। ভারতীয় ভূখণ্ডের প্রাচীনতম পূজিতা দেবীদের মধ্যে অন্যতম দেবী সরস্বতী। যাঁর আরাধনা শুরু হয়েছে বৈদিক যুগ থেকে। সেখানে তিনি বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী, জ্ঞানের দেবী। তিনি ব্রহ্মার শক্তির উৎসও বটে। তবে শুধু এই উপমাহাদেশে নয় জাপানেও মহাসমারোহে হয় সরস্বতী পুজো। সেখানে তিনি পূজিতা হন ‘বেঞ্জাইতেন’ নামে।

জাপানে অনেক জায়গাতেই জলাশয়ের মধ্যে একটি মন্দির থাকে৷ সেখানে কোনো বিগ্রহ থাকে না। জলই সেখানে বেঞ্জাইতেন দেবী৷ তবে বেঞ্জাইতেন দেবীর ছবি থেকে জানা যায়, তিনি দ্বিভুজা৷ হাতে থাকে ঐতিহ্যবাহী জাপানী বাদ্যযন্ত্র বিওয়া। এখানেই সরস্বতীর সঙ্গে মিল। তবে অমিল পূজার সময়ে। দেবী সরস্বতী পূজিতা হন কেবলমাত্র শুক্লা পঞ্চমীতে কিন্তু জাপানে সারাবছর বেঞ্জাইতেন ‘সরস্বতী’র আরাধনা হয়। জাপানে একশোরও বেশি মন্দির রয়েছে যেখানে নিয়মিত পূজিত হন দেবী বেঞ্জাইতেন। তবে এই দেবীর ধূমধাম করে পুজো হয় চিকুবু দ্বীপে, এনোশিমা দ্বীপে ও ইতসুকুশিমা দ্বীপে।

ভারতে দেবী সরস্বতী আগে যেমন ছিলেন জলের দেবী, ঠিক সেই রকম জাপানেও দেবী বেঞ্জাইতেন ছিলেন জলের দেবী। এখনও সে দেশের বেশ কিছু জলাশয়ের নাম বেঞ্জাইতেন। যেমন আমাদের দেশে সরস্বতী নামের একাধিক নদী রয়েছে। আমাদের যেমন বসন্তের আগে শীতের শেষে সরস্বতীর পুজো হয়, জাপানে পুজো হয় বর্ষার মাঝামাঝি সময়ে। প্রায় ১২০০ বছর ধরে সরস্বতীর আরাধনা করে আসছে উদীয়মান সূর্যের দেশ। জাপানের সরস্বতীর মুখের আদল আর ভারতীয় মুখ এক নয়। ভারতে সরস্বতীর হাতে বীণা থাকে, জাপানের বেঞ্জাইতেনের হাতে থাকে বিওয়া, ঐতিহ্যবাহী জাপানি বাদ্যযন্ত্র। ভারতে সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস, জাপানের বেশিরভাগ বিগ্রহে কোনো বাহন নেই।

ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে দেবী সরস্বতী কেবল জাপান নয় পৌঁছে গিয়েছেন চীন, মায়ানমার, তিব্বত, জাপান, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এমনকি ইন্দোনেশিয়ায়। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় তাঁর পরিচয়ও আলাদা আলাদা। ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে দেবী সরস্বতীর বিদেশে পাড়ি দেওয়ার অন্যতম কারণ হল বৌদ্ধ ধর্ম। হিন্দু ধর্ম ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে বন্দি থাকলেও, বৌদ্ধ ধর্ম ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। শুধু ধর্ম নয়, চীনের সঙ্গে প্রাচীন যুগ থেকে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক এই সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের অন্যতম কারণ। তিব্বতে তাঁর পরিচয় ‘ইয়েং চেন মা’। তিব্বত বহুযুগ আগে থেকেই বৌদ্ধধর্মের অন্যতম পীঠস্থান, সেখানে বজ্রযান তন্ত্রানুসারে সরাসরিভাবেই সেখানকার সংস্কৃতিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সরস্বতী।

চীনে সরস্বতী পূজিত হন ‘বিয়ানসাইতিয়ান’ রূপে। মহাযানতন্ত্রে আর্য-সরস্বতীর যে চতুর্ভূজা রূপটি বর্ণিত হয়েছে, ইনি তাঁরই চৈনিক অ্যাডাপ্টেশন। তাঁর দু’হাতে বীণাবাদন, অন্য দু’হাতে পদ্ম এবং পুস্তক। আবার কোথাও দক্ষিণ হস্তে পুস্তকের বদলে দেখা যায় হাতপাখাও। চীনের পৌরাণিক কাহিনিতে বলা হয়েছে, সমগ্র চীন সাম্রাজের দায়িত্বে ছিলেন প্রতাপশালী চার চৈনিক সম্রাট। কী উপায়ে সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা যায়— বিয়ানসাইতিয়ান সেই শিক্ষাই দিয়েছিলেন তাঁদের। দেখতে গেলে, ঠিক এই জায়গাটাতেও অদ্ভুতভাবে মিল রয়েছে ভারতীয় পুরাণের সঙ্গে। দেবী সরস্বতী বাকদেবী হলেও, তিনিই তো আদতে দণ্ডনীতির স্রষ্টা।

ভারতের আরেক প্রতিবেশী রাষ্ট্র মায়ানমারেও পূজিত হন সরস্বতী। সেখানেও বৌদ্ধ ধর্মের সূত্র ধরেই পৌঁছেছেন দেবী। বর্মায় তাঁর নাম ‘থুরাথাডি’। বিদ্যার দেবী হিসাবেই আরাধনা হয় থুরাথাডির। তবে মায়ানমারের পুরাণে তিনি কল্পিত হয়েছেন গ্রান্থাগারিক হিসাবে। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথির সংরক্ষক এবং চর্চার অধিষ্ঠাত্রী থুরাথাডি। আজও সেই আদলেই তৈরি হয় থুরাথাডির মূর্তি। তাঁর হাতে বীণার বদলে থাকে বইয়ের সম্ভার। ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও, চিন বা জাপানে সরস্বতী বন্দনা শুরু হওয়ার অনেক পরে মায়ানমারে পাড়ি দিয়েছিলেন দেবী। থুরাথাডির প্রাচীনতম লিখিত নথি বলতে যা পাওয়া যায়, সেটি একাদশ শতকের একটি বৌদ্ধ পুঁথি। তার আগে সে-দেশে থুরাথাডি সম্পর্কিত কোনো মৌখিক লোককথা বা শ্রুতির প্রচলন ছিল কিনা, তা বলা কঠিন।

চীন, জাপান কিংবা তিব্বতে দেবী সরস্বতী হংসহীনা। চীন ও জাপানে সরস্বতীর সঙ্গে দেখা যায় ড্রাগন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ড্রাগন মূলত নাগ বা সর্প। অবশ্য কম্বোডিয়ায় সরস্বতীর বাহন রাজহংস। যেমনটা দেখতে অভ্যস্ত আমরা সকলেই। একটা সময় কম্বোডিয়ায় হিন্দু ধর্মের উপাসনা হত বলেই হয়ত সরস্বতীর এমন সরাসরি রূপায়ন হয়েছে সে-দেশে। অঙ্করভাট মন্দির তো বটেই, তারও কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই কম্বোডিয়ায় একইসঙ্গে ব্রহ্মা এবং সরস্বতী আরাধনার চল রয়েছে। অষ্টম শতকের নথিতে, বিশেষত খেমার সাহিত্যে তার প্রমাণ মেলে। কম্বোডিয়ার মতো ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ডের ছবিও অনেকটাই এক। ইন্দোনেশিয়াতেও দেবীর বাহন রাজহংস। তবে থাইল্যান্ডে সরস্বতীর বাহন হাঁসের বদলে ময়ূর। পাশপাশি আরও একটি বিচিত্র জিনিসের দর্শন মেলে থাইল্যান্ডে। তা হল, দেবীর গলায় মালার বদলে অ্যামুলেট। কথ্যভাষায় এটাকে ওই লাকি লকেট বলাও চলে।
