মাইনি রিভারের পাথুরে উপকূল থেকে ডেথ ভ্যালি উপত্যকা- আমেরিকা মহাদেশের বিস্তীর্ণ এই জনপদ জুড়ে একসময় ছিল প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা ও প্রাচীন নিদর্শনে ভরপুর এক অনুপম নৈসর্গিক জনপদ। হারিয়ে যাওয়া অদ্ভুতুড়ে এই জনপদের গল্পে উঠে আসে বিভিন্ন বাহারি নিদর্শন, পিক্টোগ্রাফ, পেট্রোগ্লিফ, স্থানীয় আমেরিকানদের কৃষ্টি, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বিরাট আকৃতির মাটির ঢিবির নান্দনিক সৌন্দর্য। বহু লেখকের মোহনীয় লেখনশৈলীতে সেসবের বর্ণনা মেলে। যদিও সেইসব বইয়ের বেশিরভাগ গল্পেরা ডানা মেলেছে চমকপ্রদ কাহিনীর অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে! দৈত্য ও উড়ন্ত পাখির গল্প, সাত মাথাওয়ালা সাপেদের গল্প ইত্যাদি। সেই গল্পকথার মধ্যে বহু বছর ধরে লুকিয়ে ছিল এই স্থানের অজানা রহস্য, যা পড়ে ছিল পরিত্যক্ত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায়। ফলে বিরূপ আবহাওয়া ও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে বেশিরভাগ দৃষ্টিনন্দন স্থান ও মাটির স্থাপনা ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। হারিয়ে গিয়েছে এই সভ্যতাকে ঘিরে প্রচলিত উপকথা, লোককথা ও পৌরাণিক কাহিনীর জাদুকরী গল্পগুলি। তবে এখনও বেশ কিছু মাটির ঢিবির দেখা মেলে যেগুলি সেই গুরুত্বপূর্ণ সময়ের সাক্ষ্য দেয়।

মেক্সিকোর উত্তরে ইলিনয়ের কলিন্সভিল অঞ্চল। তার পাশেই মিসিসিপি নদী। তার ওপাড়ে দু’হাজার একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত আমেরিকার অন্যতম প্রাচীন জনপদ কাহোকিয়া। মনুষের তৈরি মাটির বিরাট ঢিবি ও পরিকাঠামোর জন্য ওই অঞ্চল লোকমুখে বেশ প্রচলিত ছিল। ৭০০-১২০০ শতকের মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে ওই শহরকে ঘিরে আদিম মানুষেরা তৈরি করেছিল ১২০টি অতিকায় ঢিবি। যার মধ্যে ১০৯টি ঢিবির মধ্যে ৬৮টি এখনও সংরক্ষিত রয়েছে। ঢিবিগুলি ছিল নান্দনিক, সেই সব ঢিবি তৈরি করতে স্থানীয় মানুষেরা ছোট ছোট ঝুড়িতে মাটি বহন করে উচুতে বহন করেচিল। সেই মাটির ক্ষয়ে যাওয়া অংশ নির্মাণকাজের সময় নির্দেশ করে। এছাড়াও ঢিবি তৈরির জন্য সেই সময় ৫০ মিলিয়ন ঘন ফুটেরও বেশি ভূপৃষ্ঠ ক্ষয়ে গিয়েছিল। আশেপাশে সৃষ্টি হয়েছিল দানবাকৃতির গর্ত, যা কাহোকিয়ার বিস্তীর্ণ জনপদে এখনও চোখে পড়ে।

তবে ঠিক কী কারণে বিশালাকার ওই ঢিবিগুলি তৈরি হয়েছিল তা আজও জানা যায়নি! তবে দৃষ্টিনন্দন ওই সব ঢিবি তৈরি হয়েছিল তিনটি ভিন্ন আকৃতিতে। এর মধ্যে সুউচ্চ ঢিবিটি পরিচিত ছিল মঞ্চ ঢিবি হিসেবে। এর নাম মঙ্কস মাউন্ড। চারটি ট্যারেস নিয়ে গঠিত ১০০ ফুট লম্বা, ৮০ ফুট চওড়া ও ৫০ ফুট উঁচু ওই ঢিবির নামকরণ করা হয় ফরাসি সন্ন্যাসীদের নামানুসারে। যারা সেই সময় ওই অঞ্চলের আশেপাশে সন্ন্যাসব্রত পালন করছিল। তারা ঢিবির আশেপাশে তৈরি করেছিল সুরভিত ফুলের বাগান। স্মরণীয় দিন, গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ কিংবা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হত ঢিবিটির সুউচ্চ সমতল চূড়া। এছাড়াও সমাধিক্ষেত্র ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান চিহ্নিতকরণে এর পাদদেশ ঘেঁষে তৈরি হয়েছিল অসংখ্য ছোট ছোট ঢিবি।

আয়তাকার এসব ঢিবিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল সারি সারি বসতভিটা, কৃষি খামার ও সবুজ-শ্যামল প্রান্তর। স্থানীয় মানুষজন সম্পৃক্ত ছিল গোলাভরা শস্য উৎপাদনে। মিসিসিপি-মিসৌরি নদীর অববাহিকায় দাঁড়িয়ে থাকা ওই জনপদ সমৃদ্ধ ছিল মৎস্য আহরণে। উর্বর দোআঁশ মাটিতে চাষাবাদ হত প্রচুর পরিমাণ ভুট্টা। মৎস্য আহরণ ও শস্য উৎপাদনের মিশ্র ওই কৃষি সমাজ ছিল যেন প্রকৃতির এক নির্মোহ আশির্বাদ। কাহোকিয়ানদের জীবন শুধু মৎস্য আহরণ, নির্মাণকাজ ও শস্য উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং খেলাধুলায়ও তারা ছিল পারদর্শী। কাজের অবসরে তারা নানা খেলায় অংশ নিত, অংশগ্রহণ করত নাচগান ও সাংস্কৃতিক আসরে। ১২০০ সালের পর কাহোকিয়ার ওই জনপদ খারাপ আবহাওয়ার কবলে পড়ে। বিলীন হতে থাকে তার সৌন্দর্য। জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারী, খরা ও সংঘাতের কারণে ১৪০০ সালে স্থানটি পুরোপুরি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়।

তবে জ্বালানি ও নির্মাণকাজে স্থানীয় লোকেদের অপরিকল্পিত বৃক্ষনিধন ইত্যাদির প্রভাবও পড়েছিল কাহোকিয়া জনপদে। এছাড়াও গ্রীষ্মকালীন বন্যা, ক্ষুধার তাড়না ইত্যাদির কারণেও বাসভূমি পরিত্যক্ত ভূমিতে পরিণত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।জে কারণে স্থানীয় লোকজন বাধ্য হযয়ে পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণের ভূমিতে স্থানান্তরিত হয়। ফলে শৈল্পিক ওই সমাজ কাঠামো ধীরে ধীরে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। তবে হারিয়ে যাওয়া রহস্যময় ওই জনপদের তেমন কোনো নথিপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি, যেখান থেকে জানা যাবে এর হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ। কেননা, ১৭ শতকের শেষাংশে ফরাসিরা যখন ওই অঞ্চলে আসে, তারাই তখন এর নাম দিয়েছিল কাহোকিয়া। তার থেকে অনুমান, কাহোকিয়া জনপদের মানুষজন ছিল অক্ষরজ্ঞানশূন্য। মজার বিষয় হল, সেই সময় কাহোকিয়ানরা মিনেসোটা ও মেক্সিকোর উপসাগরীয় সীমানা অবধি অন্যান্য উপজাতিদের সঙ্গে বাণিজ্য পরিচালনা করেছে। কাহোকিয়ার আশেপাশে সেই সময় বসবাস করতো ওসেজ, ওমাহা, পোনকা এবং কোয়াপাওসহ অন্যান্য স্থানীয় উপজাতীয় জনগোষ্ঠী। তবে, তাদের উপাখ্যানেও নেই এই মহানগরীর উল্লেখ, যা দেখে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা বিস্মিত।

১৯ শতকের শেষের দিকে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা প্রথমবারের মতো কাহোকিয়া সম্পর্কে জানতে পারেন। তারপর তারা এর রহস্য উদঘাটনে উঠে-পড়ে লাগেন। যদিও খুব অল্প স্থানই খনন করতে সমর্থ হয়েছেন তারা। খননের প্রারম্ভে আবিষ্কৃত হয় এক অত্যাশ্চর্য স্থান। যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় প্রায় ৩০০ মৃতদেহ! যাদের বেশিরভাগই যুবতী। কাছাকাছি অন্য এক কবরে দেখা মেলে একজন মধ্যবয়স্ক শাসকের কঙ্কালের, যিনি ২০ হাজারেরও বেশি সামুদ্রিক শেল ডিস্ক পুঁতির বিছানায় শুয়েছিলেন। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, এই শাসকের পরবর্তী জীবনের সেবিকা হিসেবে এসব রূপসী রমণীদের বলিদান দেওয়া হয়েছে। খননকালে আরও চারটি কঙ্কাল পাওয়া যায় যাদের হাত ও মাথা কবর থেকে হারিয়ে গেছে। এমনকি মাটিচাপা দেওয়ার আগে তাদেরকে সমাহিত করা হয়েছে বিকৃত আকৃতিতে। ধারণা করা হয়, শাস্তি হিসেবে তাদের সঙ্গে এমনটি করা হয়েছিল। সমাধিস্থলটি মূলত ৯৫০-১০০০ খ্রিস্টাব্দে খনন করা হয় বলে অনুমান।
