প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে নাকি বহু কষ্টে চীনের বাগানে গোলাপ ফোটানো হয়েছিল। জানা যায় রোমের সম্রাট একটি গোলাপ বাগান তৈরি করেছিলেন। এও জানা যায় নেপোলিয়নের স্ত্রী জোসেফাইনও গোলাপবাগ তৈরি করেছিলেন। তাঁর সেই গোলাপ বাগে বসেই জোসেফ রেডউট জলরঙ দিয়ে পৃথিবী বিখ্যাত গোলাপের ছবি “Les Roses’’এঁকেছিলেন। যদিও গোলাপের লিখিত ইতিহাস বলছে, খ্রিস্টপূর্ব ষোলো শতকের ক্রিটের দেওয়ালচিত্রে আর মৃৎপাত্রের গায়ে আঁকা ছবিতে গোলাপের দেখা মেলে। গোলাপের উল্লেখ রয়েছে খ্রিস্টজন্মের ৭০০ বছর আগের মহাকাব্য ইলিয়াড ও ওডিসিতে। হোমারের বর্ণনায় অ্যাকিলিসের ঢাল ছিল গোলাপখচিত, নিহত হেক্টরের সর্বাঙ্গে গোলাপের মলম লাগিয়ে দিয়েছিলেন আফ্রোদিতি। প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী গ্রিক দেবী আফ্রোদিতি ও রোমান দেবী ভিনাস দুজনকেই উৎসর্গ করা ফুলটি ছিল হাল্কা লাল রঙের অবিকল্প গোলাপ। তবে গোলাপকে ফুলের রাণি করেছিলেন গ্রিসের লেসবসবাসিনী গীতিকবি সাফোর। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে তাঁর বাণীবন্দনাতেই গোলাপ ফুলের রানী হিসাবে প্রথম অধিষ্ঠিত হয়। সেই থেকে বিগত দু’হাজার সাতশোরও বেশি বছর ধরে পৃথিবীতে গোলাপই একমাত্র রাজন্য, যিনি তাঁর রাজমুকুটখানি হারাননি, বরং সাম্রাজ্যটি নিরবধিই বিস্তার করে চলেছেন।

গীতি কবি সাফোর লিখেছিলেন, The rose the queen of flowers should be;/The pride of plants, the grace of bowers,/The blush of meads, the eye of flowers;/Its beauties charm the gods above,/Its fragrance is the breath of love;/Its foliage wantons in the air,/Luxuriant like the flowing hair;/It shines in blooming splendour gay,/While Zephyrs on its bosom play. আর্কেয়িক গ্রিস ও ক্ল্যাসিক্যাল গ্রিসের যুগসন্ধিক্ষণের গীতিকবি সাফোর যে গোলাপ দেখে এমন উচ্ছ্বসিত প্রশস্তি লিখে ফুলের সিংহাসনে গোলাপকে চিরস্থায়ী করেছিলেন সে গোলাপ হয়ত লেসবস দ্বীপে ফোটা পাঁচ পাপড়ির সহজ-সরল বিনম্র সুন্দর ওয়াইল্ড রোজ, অর্থাৎ ব্রিড করে ফোটানো নয়। সেই স্পিশিজ রোজের প্রজাতি শতাধিক নয় কিন্তু এখন ব্রিড রোজের রকম প্রায় তিন হাজার। প্রাকৃতিক আদিম গোলাপের পাপড়ির সংখ্যা পাঁচ, কিন্তু ব্রিড রোজের পাপড়ি পাঁচের অনেক বেশি। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর আরেক কবি অ্যানাক্রিয়ন তাঁর স্তবগানে গোলাপের আবির্ভাব বর্ণনায় কীভাবে প্রেমদেবী আফ্রোদিতির সমুদ্র থেকে অভ্যুত্থানের অভিঘাতপ্রসূত শুভ্র সমুদ্রফেনা থেকে তাঁর যোগ্য প্রতিনিধি গোলাপের অভ্যুদয় ঘটেছিল তা বর্ণনা করেন। কবির দেখা সেই গোলাপও ছিল প্রাকৃতিক।

জাপানি উদ্ভিদবিদ মিকিনোরি ওগিসুর ‘মাই ওয়ার্লড অব প্লান্টস’ বই থেকে জানা যায় অন্তত হাজার বছর আগে থেকে চীন গোলাপের সংকরায়ন পদ্ধতি শিখে আধুনিক গোলাপের উদ্ভাবন ও উৎপাদন করে আসছে। পাশাপাশি ইউরোপ-আমেরিকার কাল্টিভার রোজের বয়স মাত্র দুশো বছর। এই উপমহাদেশের গোলাপের ইতিহাসও পাঁচ হাজার বছরের বেশি পুরনো। পুরাণ বলছে, একবার কোন ফুল শ্রেষ্ঠ এই নিয়ে ব্রহ্মার সঙ্গে বিষ্ণুর বিবাদ বেধেছিল। ব্রহ্মা বলেছিলেন পদ্ম, আর বিষ্ণু গোলাপকে শ্রেষ্ঠ বলেছিলেন। বিষ্ণুর বাগানেও নাকি গোলাপ ছিল। এর থেকে অনুমান করা যায়, হিমালয়েও এক সময় গোলাপ ফুটত। হতে পারে সেই গোলাপ ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্সে ফুটত। প্রাচীন আয়ুর্বেদে গোলাপের উল্লেখ মিলেছে খ্রিস্টপূর্ব ১০০ বছর আগে। সেখানে গোলাপ ব্যবহার হচ্ছে ঔযধি হিসেবে। ৩২৭ খ্রিস্টপূর্বে আলেকজ্যান্ডার যখন ভারতবর্ষে ছিলেন, তখন তিনি এদেশের বেশ কিছু গোলাপ গাছ পাঠিয়েছিলেন তাঁর গুরু অ্যারিস্টটলকে।

শোনা যায়, মুঘল সম্রাট বাবর নাকি প্রথম এ দেশে গোলাপ এনেছিলেন। তথ্য কতটা ঠিক বলা মুশকিল তবে গোলাপ যে তাঁর প্রিয় ছিল সেকথা বলা যায় তাঁর মেয়েদের নাম দেখে- গুলচিহারা, গুলরুখ, গুলবদন, গুলরঙ; পার্সিতে গুল শব্দের অর্থ গোলাপ। কেবল বাবর নন, তাঁর উত্তরপুরুষ আকবর নাকি উটের পিঠে চাপিয়ে বন্ধুদের স্ত্রীদের জন্য গোলাপ পাঠাতেন। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের বেগম সম্রাজ্ঞী নূরজাহান জলে গোলাপ ফুলের পাপড়ি ফেলে স্নান করতেন, গোলাপের আতর ছড়াতেন সারা শরীরে। এই উপমহাদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে গোলাপ জড়িয়ে আছে প্রাচীনকাল থেকে। হিন্দু বিয়ে, উৎসব, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা প্রায় সব কিছুতেই গোলাপের ব্যবহার দেখা যায়। সুগন্ধি তৈরিতেও যেমন গোলাপের ব্যবহার আছে তেমনি ‘দ্য গ্রেট কারিজ অব ইন্ডিয়া’য় গোলাপের পাপড়ি ব্যবহার করে বিভিন্ন পদের বিবরণ আছে। ভারতবর্ষের প্রাচীন গ্রন্থগুলোয় গোলাপ নিয়ে বিস্তারিত কিছু পাওয়া যায় না।

তবে গত কয়েক দশকের প্রত্নতাত্ত্বিক খননে দেখা গেছে সিন্ধু সভ্যতায়ও গোলাপের ব্যবহার ছিল। সেখানে সুগন্ধি তেল তৈরিতে গোলাপ ব্যবহার করা হতো। ইতালির মিলানে অবস্থিত Instituto Derivati Vegetali-র পরিচালক ড. পাওলো রোভেসতি ১৯৭৫ সালে পাকিস্তানে অবস্থিত সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে অভিযান চালান। সেখানে তিনি তক্ষশীলা জাদুঘরে সুগন্ধি তৈরির জন্য পাতন প্রক্রিয়ায় ব্যবহূত টেরাকোটার যন্ত্রপাতি দেখতে পান। এসব যন্ত্রপাতি সিন্ধু সভ্যতার, যেগুলোর বয়স পাঁচ হাজার বছর। একই সময়কার সুগন্ধি রাখার কনটেইনারও সংরক্ষিত আছে জাদুঘরে। এ থেকে সিন্ধু সভ্যতায় সুগন্ধি তেল ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে ভারতবর্ষে গোলাপের ব্যবহার বিস্তৃত হয় পঞ্চদশ শতকে মোগলদের হাত ধরে। মোগল-শ্রেষ্ঠ আকবরের আমলে প্রতিকৃতি অংকনের রীতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আকবর গোলাপকে অমর করে রেখে গেছেন একটি প্রতিকৃতিতে, যেখানে তাকে গোলাপ হাতে দেখা যায়। শাহজাহানের আমলে তার নির্দেশে প্রস্তুতকৃত শেখ সাদির গুলিস্তাঁর পাণ্ডুলিপিতে গোলাপের চিত্র দেখা যায়।

প্রসঙ্গত, প্রতি বছর ২২ সেপ্টেম্বর যে বিশ্ব গোলাপ দিবস পালিত হয়, তার সঙ্গে কিন্তু গোলাপ ফুলের তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। আসলে এই দিনটি উৎসর্গ করা হয়েছে মেলিন্ডা রোজের স্মৃতিতে। কানাডাবাসী মেলিন্ডার ক্যানসার রোগ ধরা পড়ে মাত্র ১২ বছর বয়সে। আস্কিন টিউমারের মতো বিরল রোগে আক্রান্ত মেলিন্ডাকে জবাব দিয়ে দিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। যে হেতু হাতে সময় খুব কম, তাই এক মুহূর্তও নষ্ট না করে মেলিন্ডা অন্যান্য ক্যানসার রোগীদের উদ্দেশে কবিতা লিখে, মেল করে তাঁদের জীবন ভরিয়ে দেয় ভালবাসা আর আনন্দে। সেই জন্যই ২২ সেপ্টেম্বর এই দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে বিশ্ব গোলাপ দিবস বা ওয়ার্ল্ড রোজ ডে পালন করার জন্য।
