পঞ্চম পর্ব
রাজা ব্যানার্জি| ছবি: ইন্দ্রনীল গাঙ্গুলি ও রুদ্ররাজ দাষ
গত কয়েকদিনের ধকলে শরীরটা ততটা যুতসই না হলেও, সবার মনটা আজ বেশ চনমনে ঠেকলো। কারণ, বিরাট কোনো বিপদের মুখোমুখি না হলে আজই আমরা পৌঁছব সান্দাকফু। নুডলস দিয়েই ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা দিলাম কালিপোখরি থেকে। এখান থেকে সান্দাকফু প্রায় ষাট ডিগ্রি খাড়াইয়ে উঠে গিয়েছে পাহাড়ি পথ।
টোংলু থেকে দুদিনে নেমেছি হাজার ফুটের বেশি। আজ কালিপোখরি থেকে সান্দাকফু পৌঁছাতে তাই চড়তে হবে তিন হাজার ফুটের বেশি। কারণ টোংলু থেকে সান্দাকফু আরো দুহাজার ফুট উঁচুতে। তিন হাজার ফুট মানে কতটা ? ধরে নিন, দার্জিলিং-এর প্রায় অর্ধেক উচ্চতা। মাঝে পড়বে আর একটিই গ্রাম, বিকেভঞ্জন। সেখান থেকে পৌনে এক ঘন্টার পথ সান্দাকফু। বেলা একটা-দেড়টা নাগাদ পৌঁছালাম বিকেভঞ্জন। সেখানে চা-কফি মিললো একটা দোকানে।
ওখানেই রয়েছে চোর্তেন। আদতে একটি স্তুপ। স্থানীয় ভাষায় বলে চোর্তেন। সেখানে ট্রেকিং-এ যাওয়া মানুষেরা পুজো দেন। সে অর্থে কোনো মন্দির বা গুমফা নেই। আছে ছোট একটি স্তুপ। কোনো দেবদেবীর বিগ্রহ নেই। পুজোর ও কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই। নেই ফুল, চন্দন। কেউ নানা রঙের পতাকা টাঙান। কেউ জ্বালান মোম। কেউবা আবার বিপদমুক্ত করার কামনায় কিছু পাথর সাজিয়ে আসেন সেখানে। যে যেভাবে পারেন খানিকটা সাজিয়ে তোলেন এলাকাটিকে। আমাদের সকলের হয়ে চোর্তেনে পুজো দেওয়ায় দায়িত্বটা বর্তেছিল আমার ওপরেই। আমি যে বিরাট ধর্মপ্রাণ তা নই। বরং উল্টোটাই বেশি সত্যি। কিন্তু পাহাড়ি এলাকায় মানুষের ওই সরল এবং গভীর বিশ্বাসে আঘাত করার মানসিকতাও ছিল না। আমাদের সাত জনের উদ্দেশ্যে ছোটবেলার পিট্টু খেলার মতো সাতটি পাথর সাজিয়ে প্রার্থনা করলাম, এতটা পথ তো চড়লাম। বাকিটাও চড়ে নিরাপদে যেন নামতে পারি। বস্তুত গাইড থেকে ট্রেকার, সকলের একই প্রার্থনা।
পুরো যাত্রাপথে একমাত্র সান্দাকফুতে রাতের আশ্রয় নিয়েই আমাদের খানিক দুশ্চিন্তা ছিল। কারণ সেটা গাইডের হাতে ছিল না। তাই বাকিরা খানিক বিশ্রাম নিতে নিতেই আমি আর দেবজিত আগেভাগেই বেরিয়ে পড়লাম। যতটা আগে গিয়ে পৌঁছতে পারি ব্যবস্থা করার জন্য, ততটুকু বেশি সময় মিলবে। খানিক পথ পেরোনোর পর চোখে পড়লো ট্রেকারদের জন্য একটা বসার ব্যবস্থা। সেই বেঞ্চে গিয়ে বসলাম দুজন। দিনের বেলাতেও বইছে কনকনে বাতাস। আমাদের ব্যাগেই ছিল যথেষ্ট সংখ্যক চকোলেট আর পার্ক। দুজনে দুটো পার্ক খেয়ে মনে হলো, বাকিরাও তো আসবে এ পথেই। এই জায়গাটা দেখে নিশ্চয়ই একবার বসবে। সে কথা ভেবে বাকিদের জন্যও কয়েকটা পার্ক রেখে এগোতে শুরু করলাম সান্দাকফুর উদ্দেশে।
সান্দাকফু পৌঁছেই প্রথম কিছুক্ষন যেন নির্বাক হয়ে গেলাম দুজনেই। দিনের বেলাতেই হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা। শনশন করে বইছে হাওয়া। কিন্তু সেই উপত্যকায় বসে দেখলাম, নীল আকাশের নিচে সত্যি সত্যিই যেন গভীর এক প্রশান্তিতে শায়িত বুদ্ধ। তাকে শিব হিসেবেও কল্পনা করা যেতেই পারে। মনে পড়লো অরিন্দমদার কথাটা। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে হলে সান্দাকফু যেতে হবে। নিচের উপত্যকা আর পাশের জনপদের অনেকটাই দেখলাম বরফে ঢাকা।
ঘরের ব্যবস্থাও হয়ে গেল। আহামরি কিছু নয়। কিন্তু পরিচ্ছন্ন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সহ। একটাই বড় কাঠের ঘরে জায়গা করে দেওয়া হলো আমাদের। সে ঘরেই আটটি খাট পাতা। মালকিন জানালেন, শুধু চাল, ডাল আর ডিম আছে ঘরে। খিচুড়ি আর ডিম ভাজা হতে পারে। তার চেয়ে বেশি কিছু সম্ভব নয় আজ। বেলা তখন প্রায় চারটে। এতটাই খিদে পেয়েছিল যে আমরাই সাবড়ে দিলাম আস্ত এক ডেচকি খিচুড়ি।
কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপে আমরা এতটাই মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম যে সবাই মিলে গিয়ে দাঁড়ালাম সেই খোলা জায়গাটায়। সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা, মাঝে আর কিছু নেই। যা আছে সবই নিম্ন উপত্যকায়। কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে না।সামনে ১৮০ ডিগ্রি জুড়ে নীল আকাশের নিচে বাঁদিকে মাউন্ট এভারেস্ট এবং আরো দুটো শৃঙ্গ, মধ্যিখানে কাঞ্চনজঙ্ঘা, ডানদিকেও আরো একটি পর্বতশ্রেণী।
সন্ধ্যার পর তাপমাত্রা আরও নামলো। সঙ্গে মনে হচ্ছে যেন বাইরে ঝড় বইছে। তবু মনে হলো, রাতের রূপটা একবার না দেখলে দেখাটাই যে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিয়েই বাইরে এলাম। শুধু চোখদুটিই খোলা। বাইরে বেরিয়ে মনে হলো, প্রবল ঠান্ডা বাতাস যেভাবে ঝড়ের মতো বইছে তাতে অন্ধ না হয়ে যাই।
মেঘ কেটে আকাশে তখন ফুটফুটে জ্যোৎস্না। আর সেই আলো কাঞ্চনজঙ্ঘায় প্রতিফলিত হয়ে যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। অপার্থিব সেই দৃশ্য। প্রশান্তিতে শায়িত দেবাদিদেব মহাকাল। আর পাহাড়ের নিচের দিকের যে অংশে বরফ জমেনি, দিনের বেলায় সে অংশটি কালো ঠেকছিল। সন্ধ্যায় দেখলাম, যেন হাজার আলো চিকমিক করছে সেখানেই। হয়তো কোনো ধাতু। তা থেকেই জ্যোৎস্নার আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। কিন্তু সে রাতে তাকেই মনে হলো যেন লাখো জোনাকির মিছিল।
চলবে কিন্তু সামনের কিস্তিতেই শেষ…