মানব সভ্যতা এগিয়ে চলার দুটি চাকা এক; নারী, দুই; পুরুষ। সভ্যতার নানা উত্থান, অর্জন এসেছে নারীর হাত ধরে। শিল্প-সাহিত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান সর্বত্রই নারীর সফল পদচারণা। মানবসেবা ও আবিষ্কারে নারী বরাবরই ইতিহাসে নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছেন। ইতিহাস কাঁপানো বহু নারী খুব সাধারণ অবস্থান থেকে উঠে এসেছেন ইতিহাসের পাতায়। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে তারা দেখিয়েছেন একান্ত প্রচেষ্টা থাকলে জয় নিশ্চিত। আকাশ জয়ের গল্প রয়েছে নারীর। যুগে যুগে যুদ্ধের ময়দানে পুরুষের পাশাপাশি লড়েছে নারী। আকাশপথে যোদ্ধা নারীর কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় সাবিহা গকসেনের কথা। উনিশ শতকে তুরস্ক দেখেছিল নারী যোদ্ধা পাইলট সাবিহাকে। সাবিহা পৃথিবীর প্রথম নারী যোদ্ধা পাইলট। মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি ইস্কিসিরের সামরিক বিমানবাহিনীতে যোগ দেন। যদি অন্যান্য ভূমিকায় তাঁর আগে ম্যারি মারভিন্ত ও ইহিনি মেখেইলোভনারকে দেখা গিয়েছিল। সাবিহা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের পালিত আট সন্তানের মধ্যে অন্যতম। তবে তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে ছিল বিতর্ক।

ছোটবেলাতে মা-বাবা হারিয়ে সাবিহা গকসেন অনাথ হয়ে যান, তাঁর জীবনে নেমে আসে অবর্ণনীয় দুঃখ। পড়াশোনা করে তাঁর বড় হওয়ার স্বপ্ন মুখ থুবড়ে পড়ে আবার তিনিই কি না ইতিহাসে নাম লেখান বিশ্বের প্রথম নারী যুদ্ধবিমান চালক হিসেবে! সাবিহা গকসেনের জন্ম উসমানীয় সাম্রাজ্যের বুরসায়। তাঁর মা হায়রিয় হানাম এবং বাবা মোস্তফা ইজ্জত বে দুজনেই বসনিয়ান বংশোদ্ভূত। মাত্র সাত বছর বয়সে বাবা ও ১২ বছর বয়সে মাকে হারিয়ে জীবন খুব অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। তুরস্ক তখন পরাধীন ছিল। তাই যুদ্ধবিগ্রহের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল ছোটবেলাতেই। ১৯২৫ সালে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক যখন বুরসা সফর করেন, তখন তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং বোর্ডিং স্কুলে পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন।

তারপর আতাতুর্ক তার জীবনের দুর্বিষহ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারেন এবং তাঁকে দত্তক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সাবিহা গকসেনের ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে তিনি তাঁকে আঙ্কারার কানকায়া রাষ্ট্রপতি বাসভবনে নিয়ে যান, যেখানে সাবিহা গকসেন কামাল আতাতুর্কের আরও কিছু দত্তক নেওয়া সন্তানের সঙ্গে বড় হতে থাকেন। সাবিহা গকসেন কানকায়া প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ইস্তাম্বুলের উস্কদার আমেরিকান একাডেমিতে পড়াশোনা করেন। মাত্র ২৩ বছর বয়সে পাইলট হন তিনি। ১৯৩৭ সালের মার্চে কুর্দি বিদ্রোহ দমনে পাঠানো হয় তাঁকে। সেখানে শত্রু শিবিরে বোমা হামলা করে সফলভাবে ফিরে আসেন তিনি। ওই বছরেই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং চিফ অব জেনারেল স্টাফের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে তাঁকে তুর্কি অ্যারোনটিকাল অ্যাসোসিয়েশন মুরাসা (সম্মান) পদক দেওয়া হয়। তিনি রাশিয়ায় গিয়ে আরও উচ্চতার গ্লাইডার প্রশিক্ষণ শেষ করেছিলেন এবং আঙ্কারায় উচ্চ গ্লাইডিং ব্যাজও পেয়েছিলেন।

১৯৩৮ সালে বলকান দেশগুলোর চারপাশে পাঁচ দিন বিমান চালিয়ে সবার কাছে প্রশংসিত হন তিনি। ওই বছরই তুর্কি অ্যারোনটিকাল অ্যাসোসিয়েশনের তারক্কুসু ফ্লাইট স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন এবং ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত ফ্লাইট প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ওই সংস্থার কার্যনির্বাহী বোর্ডের সদস্য হন তিনি। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ তার ক্যারিয়ারের ২৮ বছরে তিনি তুর্কি বিমানবাহিনীতে ৮ হাজার ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিমান চালান। এর মধ্যে ৩২ ঘণ্টা তিনি বিমান চালিয়ে আকাশপথে যুদ্ধ করেছেন এবং বোমা হামলা মিশনে অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি মোট ২২টি বিভিন্ন ধরনের বিমান চালানোর সুযোগ পেয়েছিলেন। এডিবে সুবাসি, ইল্ডিজ উসমান, সাহেভেত কারাপস এবং নেজিহে বিরানিয়ালের মতো নারী বিমানচালকের প্রশিক্ষক ছিলেন সাবিহা গকসেন।

প্রথম নারী যোদ্ধা পাইলট হিসেবে তিনি গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড-এ নাম লেখান। শুধু তাই নয়, ১৯৯৬ সালে আমেরিকার এয়ারফোর্স প্রকাশিত ‘দ্য ২০ গ্রেটেস্ট অ্যাভিয়েটর্স ইন হিস্ট্রি’-এর পোস্টারের জন্য একমাত্র নারী পাইলট হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। পেশাগত জীবনে তিনি বৈমানিক ছাড়াও লেখক ও বক্তাও ছিলেন। বিভিন্ন দেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন তুর্কি নারীদের কথা। ১৯৪০ সালে তিনি কামাল ইজিনারকে বিয়ে করেছিলেন। তবে মাত্র তিন বছর পরেই তার সংসার জীবনের ইতি ঘটে। ৮৩ বছর বয়সে পাইলট ড্যানিয়েল অ্যাক্টনের সঙ্গে তিনি শেষবারের মতো ফ্যালকন ২০০০ বিমান চালান। ২০০১ সালে ৮৮ বছর বয়সের জন্মদিনে অর্থাৎ ২২ মার্চ তুরস্কের আঙ্কারায় গুলিহান মিলিটারি মেডিকেল একাডেমিতে হৃদরোগজনিত কারণে মৃত্যু হয় এই সাহসী নারীর।
