বিচারক অপরাধকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ বলে মনে করলেন না। তাই এদেশের সর্বোচ্চ সাজা ‘ফাঁসি’ নয়, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হল তাঁকে। সঙ্গে রাজ্য সরকারকে নির্যাতিতার পরিবারকে ১৭ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাই আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুনের রায় ঘোষণার পরও থেকে গেলো একটি অতি পরিচিত প্রশ্ন- সঞ্জয় রায় কি এই ঘটনায় একমাত্র দোষী? আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের পর এক অভূতপূর্ব বিক্ষোভের সাক্ষী থেকেছিল পশ্চিমবঙ্গ। প্রতিবাদ রাজ্য ও দেশের সীমা ছাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছিল বিদেশে। ১৬২ দিন পরে রায় ঘোষণা হলেও তাতে কি কেউ সন্তুষ্ট হয়েছেন? বরং সিবিআই-এর তদন্ত নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু সেই তদন্তের ভিত্তিতেই রায় দিয়েছে আদালত। রায় নিয়ে খুশি হতে পারেননি নির্যাতিতার পরিবার থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজন। সঞ্জয় রায় দোষী সাব্যস্ত হলেও সে যেচএকমাত্র দুষ্কৃতী নয়, এই জনমত প্রবল হয়ে উঠেছে।

বিচারককে ধন্যবাদ জানিয়েও নিহত চিকিৎসকের বাবা বাবা বলেছেন, “এই রায় নিয়ে আমাদের খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল না। সঞ্জয় একা এই কাজ করেছে, এটা আমরা মনে করি না। তাই ওর পাশাপাশি অন্য যারা এ কাজে যুক্ত ছিল, তাদের সাজা হলে বিচার সম্পূর্ণ হবে।” জুনিয়র ডাক্তাররা কার্যত হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, “যে অপরাধ একজনের নয়, তাকে একজনের চিহ্নিত করে চার্জশিট দিয়েছে সিবিআই। তার ভিত্তিতে আদালত রায় দিয়েছে। সঞ্জয় দোষী ঠিকই, কিন্তু সে একা ছিল না। যতক্ষণ না বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের ছবিটা সামনে আসছে, ততক্ষণ এই তদন্ত সম্পূর্ণ হবে না। আজকের রায় ঘোষণার সঙ্গে আদৌ এই মামলার নিষ্পত্তি হচ্ছে না। তাই সুবিচারের দাবিতে আন্দোলন আগামীতেও চলবে এবং জোরদার হবে।” আর জি কর আন্দোলনের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রের অনেক বিশিষ্ট মানুষ জড়িয়ে পড়েছিলেন। প্রথম থেকেই বোঝা গিয়েছিল একজন দোষী, কিন্তু আরও অপরাধী বাইরে রয়েছে। তাদের চিহ্নিত করতে হবে সিবিআইকে। তদন্তকারীরা যাতে সেটা নিরপেক্ষভাবে করেন, সে জন্যই আন্দোলন।

উল্লেখ্য, আরজি করের চিকিৎসক হত্যার নৃশংসতায় শিউরে উঠেছিল সমাজ। নিন্দায় মুখর হয়েছিলেন সব বয়সের মানুষ। সবাই বুঝেছিলেন সঞ্জয় রায় একা নয়, আরও অনেকে জড়িত ছিল। তাদের কী খবর? পুরো ব্যাপারটায় যে হতাশার জায়গাগুলো, তদন্তের যে ফাঁকগুলি রয়েছে, যে প্রশ্নগুলি আছে, তার জবাব মিলল না। বাকি অপরাধীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে বিক্ষোভে ছিলেন সাধারণ মানুষও। সঞ্জয় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও কেন তথ্যপ্রমাণ লোপাট করা হল। কেন গ্রেপ্তার করা হলেও সন্দীপ ঘোষ ও অভিজিৎ মন্ডলের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হল না। ফরেনসিক রিপোর্টে একাধিক ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া গেল, ঘটনাস্থল ওটা নয় বলে সন্দেহ তৈরি হল, সিবিআই চার্জশিটের উপর ভিত্তি করে যে রায় হল, তাকে কেউ মানতে পারলো নাস কেন? সঞ্জয়কে কলকাতা পুলিশ গ্রেপ্তার করল, তাকেই অভিযুক্ত করে চার্জশিট দিল সিবিআই। কিন্তু তার মধ্যে থেকে গেল অনেক ধোঁয়াশা। সিবিআই তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন গোড়া থেকেই ছিল। ফরেনসিক রিপোর্ট সামনে আসার পর সেই প্রশ্ন আরও জোরালো হয। যে সেমিনার রুমে দেহ উদ্ধার হয়েছিল, সেখানে ধস্তাধস্তির চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তা হলে কি বাইরে কোথাও খুন করে এখানে দেহ ফেলে রাখা হয়েছিল?

রাজ্যের প্রাক্তন পুলিশ কর্তারাও অনেকে বলেন, মনে হয় একাধিক ব্যক্তির এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সম্ভাবনা বেশি। ওই চিকিৎসক একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে কর্তব্যরত ছিলেন। সেখানে বাইরের একজন এসে ধর্ষণ, খুন করল, এটা অস্বাভাবিক। হাসপাতালের কেউ এর সঙ্গে জড়িত না থাকলে এমন ঘটনার সম্ভাবনা কম। ওই মহিলা চিকিৎসক কোনো কারণে হাসপাতালের দুর্নীতি চক্রের বিষ নজরে পড়ে যান, তাই তাকে খুন করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিবিআই সঞ্জয় রায়কে মূল অভিযুক্ত করে চার্জশিট পেশ করে। কিন্তু ধর্ষণ ও খুনের মামলায় সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট পেশ করে আরজিকরের সাবেক অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার ওসি অভিজিৎ মন্ডলকে অভিযুক্ত হিসেবে দেখাতে পারেননি তদন্তকারীরা। এর জন্য তারা জামিন পেয়ে যান।

কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্তের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আঙুল ওঠে। ৯ আগস্ট দেহ উদ্ধারের আগের রাতে যারা হাসপাতালে কর্তব্যরত ছিলেন, তাদের হেফাজতে নিয়ে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কলকাতা পুলিশ সঞ্জয় রায়কে গ্রেপ্তার করেছিল। তার নামেই চার্জশিট দেয় সিবিআই। বাকিদের ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হল কেন? জানা যায়, সেমিনার রুম ঘটনার অকুস্থল নয়। ওই ঘরটার মধ্যে এত লোক সেদিন ঢুকে পড়েছিল, যেখানে বাবা-মা বাইরে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলেন। কলকাতা পুলিশ সঞ্জয় রায়কে গ্রেপ্তার করল, বাকিদের কী হল? এই প্রশ্নের উত্তরগুলি কিন্তু পাওয়া গেল না। অর্ধনগ্ন দেহ দেখেও কেন আত্মহত্যার তত্ত্ব সামনে আনা হল, কেন দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত না করে দ্রুত দেহ সৎকার করা হল? খুনের মামলা রুজু হওয়াতে বিলম্ব কিংবা অভিযোগ জানাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের গড়িমসি, এ সব অভিযোগ আতসকাচের তলায় রয়ে গেল। ফরেনসিক ল্যাবরেটরির রিপোর্টে একাধিক ব্যক্তির যুক্ত থাকার কথা বলা হয়েচিল। সেমিনার রুমেই এটা হয়েছে কি না, তা নিয়ে অনেক কথা শোনা গিয়েছিল। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে আর যারা জড়িত, তাদের সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দিয়ে বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে?

তাই সঞ্জয় রায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই মামলা শেষ হয় না। এরপর আদালতে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দাখিল করতে হবে তদন্তকারী সংস্থাকে। বিচার প্রক্রিয়া চলবে নিম্ন আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। বিচারের দাবিতে আন্দোলন ও সুবিচারের জন্য অপেক্ষা ফুরোচ্ছে না। প্রশ্নগুলি সহজ হলেও সঙ্গত তাই অভয়ার বাবা-মা যেভ৫৯টি প্রশ্ন করেছজে সেই প্রশ্নের উত্তর না দিতে পারলে সবটাই যে মিথ্যা তা খুবই স্পষ্ট।
