পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ এবং সৌর জগতের পঞ্চম বৃহত্তম উপগ্রহ হল চাঁদ। পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে চাঁদের কেন্দ্রের গড় দূরত্ব হচ্ছে ৩৮৪,৪০০ কিলোমিটার অর্থাৎ প্রায় ২৩৮,৮৫৫ মাইল যা পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ৩০ গুণ। তার মানে চাঁদের আয়তন পৃথিবীর আয়তনের ৫০ ভাগের ১ ভাগ। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব সবসময় এক থাকে না। কখনো বাড়ে আবার কখনও কমে। চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে চলে এসেছিল ১৯১২ সালের ৪ জানুয়ারি। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ছিল মাত্র ৩,৪৮,২৫৯ কিলোমিটার (২,১৬,৩৯৮ মাইল)।চাঁদের থেকে পৃথিবীর দূরত্ব সর্বোচ্চ স্তরে গিয়েছিল ১৯৮৪ সালের ২রা মার্চে। এই দিনে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ছিল ৩,৯৮,৫৯৮ কিলোমিটার (২,৪৭,৬৭৫)।

প্রাচীনকালে বেশির ভাগ মানুষ মনে করত, চাঁদ প্রত্যেক রাত্রিতে মরে ছায়ার জগতে চলে যায়। কেউ কেউ বিশ্বাস করত যে চাঁদ সূর্যকে পিছু করছে। পিথাগোরাসের সময়, চাঁদকে একটি গ্রহ হিসেবে মনে করা হত, মানুষ বিশ্বাস করত যে চাঁদ হয়ত একটি নির্ভুলভাবে মসৃণ গোলক যা অ্যারিস্টটলের তত্ত্ব সমর্থন করত এবং অন্যান্যরা মনে করত সেখানে সাগর আছে। গ্যালিলিও যখন তাঁর দূরবীক্ষণ চাঁদের দিকে ধরলেন, তিনি দেখলেন যে চাঁদের উপরিতল মসৃণ ছিল না। তা ক্ষুদ্র কালো রেখা, উপত্যকা, পর্বত এবং খাদের গঠিত হয়। সেই মুহূর্ত থেকে তিনি অনুভব করতে শুরু করেন যে এটি পৃথিবীর মতোই একটি কঠিন গলিত পদার্থ ছিল যা পরে এই রূপ নেয়। তারপরে মনে করত যে চাঁদের শ্বাস গ্রহণের উপযোগী বায়ুমণ্ডল আছে এবং কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানী একটি ক্ষুদ্র বায়ু স্তরের উপস্থিতি আছে বলে অনুমান করত কারণ চাঁদ পর্যবেক্ষণ সময় তারা অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু উড়ন্ত বস্তু দেখেছিল।

চাঁদই একমাত্র জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তু যাতে মানুষ ভ্রমণ করেছে এবং যার পৃষ্ঠতলে মানুষ অবতরণ করেছে। প্রথম যে কৃত্রিম বস্তুটি পৃথিবীর অভিকর্ষ অতিক্রম করেছিল এবং চাঁদের কাছ দিয়ে উড়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল তা হল সোভিয়েত ইউনিয়নের লুনা ১। লুনা ২ প্রথবারের মত চাঁদের পৃষ্ঠতলকে প্রভাবান্বিত করেছিল। চাঁদের দূরবর্তী যে অংশটা স্বাভাবিকভাবে লুকায়িত থাকে তার প্রথম সাধারণ ছবি তুলেছিল লুনা ৩। এই তিনটি ঘটনাই সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিচালনায় ১৯৫৯ সালে সংঘটিত হয়। ১৯৬৬ সালে লুনা ৯ প্রথমবারের মত চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করে এবং লুনা ১০ প্রথমবারের মতো চাঁদের কক্ষপথ পরিক্রমণ করতে সমর্থ হয়। ২০০৯ সালে ভারত চন্দ্রযান নামে একটি মহাকাশযান চাঁদে পাঠায়। কিন্তু প্রকল্পটি ব্যর্থ হয়। মহাকাশযান চাঁদে পৌঁছানোর পরেই তার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু অল্প সময়ে যে তথ্য পাঠিয়েছে তা মানব জাতিকে নতুন করে আশার আলো দেখিয়েছে, চাঁদে জীবের অস্তিত্ব থাকার কারণ সেখানে জলের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে৷ তবে ২০১৯ সালের ২২ জুলাই ভারতের ইসরো, চন্দ্রযান-২ নামে পুনরায় একটি মহাকাশযানের সফল উৎক্ষেপণ করে

সেই চাঁদ রাতের আকাশ উজ্জ্বল করে রাখে। পৃথিবীর সব জায়গা থেকে চাঁদের আলো দেখা যায়, তবে সময় ভেদে। যদি কোনো দিন দেখা যায় আকাশে চাঁদ নেই, চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার! এমনটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়! ১১১০ সালে একদিন হঠাৎ করে আকাশ থেকে রহস্যজনকভাবে গায়েব হয়ে যায় চাঁদ। অবাক করা বিষয় হল, মেঘ কিংবা চন্দ্রগ্রহণ কোনোটিই এই ঘটনার জন্য দায়ী ছিল না। ভয়াবহ এক বিষ্ময়ের আঁধার নেমে আসে পুরো পৃথিবীজুড়ে। চাঁদ উধাও হওয়ার এই রহস্যের কূল-কিনারা দীর্ঘ ৯০০ বছরেও হয়নি। এই রহস্যজট উন্মোচন করে স্ইুজারল্যান্ডের জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখান থেকে নেচার জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। তাদের গবেষণা পত্রের শিরোনাম ‘ক্লাইমেট অ্যান্ড সোশ্যিয়াটাল ইমপেক্টস অব আ ‘ফরগোটেন’ ক্লাস্টার অব ভলকেনিক এরাপশনস ইন ১১০৮-১১১০’।

গবেষণা অনুযায়ী, চাঁদের অদৃশ্য হওয়ার পেছনে রহস্য কী ছিল? পুরনো একটি পুঁথি থেকে পাওয়া যায়, ১১১০ সাল ছিল সাংঘাতিক বিপর্যয়ের একটি বছর। মুষলধারে ভারী বৃষ্টিপাত, ক্ষতিগ্রস্থ ফসল, দুর্ভিক্ষ এবং ধারাবাহিক অগ্নি উৎপাত সব যেন একই বছরে হানা দিয়েছিল এই গ্রহে। আর চাঁদের অদৃশ্য হওয়ার পেছনে দায়ী ছিল একই সময়ে পরপর অনেকগুলো নিরবিচ্ছিন্ন অগ্নি উৎপাত। ১১০৮ থেকে ১১১০ সালের মধ্যে ইউরোপ ও এশিয়ার সর্বাধিক আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে উৎপন্ন ছাই মেঘের সঙ্গে মিশে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে বিশ্ব জুড়ে ভেসে বেড়ায়। এই বিষয়টি টের পাওয়া যায়, যখন গবেষকদের একটি দল গ্রিনল্যান্ড ও অ্যান্ট্যার্ক্টিকায় প্রাচীন হিমবাহের গঠন পরীক্ষা করেন। সেই সঙ্গে তৎকালীন সময়ের পুরনো কিছু গাছের ফসিল পরীক্ষা করে দেখা গেল, গাছের কান্ডের রিংগুলোর পুরত্ব স্বাভাবিক নয়। উদ্ভিদের এই পরিবর্তনের ফলে ১১০৯ সালে ইউরোপের আবহাওয়া হয়েছিল অস্বাভাবিক ঠান্ডা ও বৃষ্টিমুখর। এই ধরনের প্রাকৃতিক পরিবর্তন বড় বড় আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের ফলেই ঘটে বলে বহু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে এর আগেও।

তবে অগ্নি উৎপাতগুলো আসলে কোথায় হয়েছিল, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি গবেষক দলটি। কিছু পুরনো ম্যাগাজিন ঘেটে জানা যায়, ১১০৮ সালে জাপানের আসামা আগ্নেয়গিরিতে টানা তিন মাস ধরে অগ্নি উৎপাত অব্যাহত ছিল। আর গ্রিনল্যান্ডের বরফে সালফেটের উপস্থিতি এই আসামা আগ্নেয়গিরির প্রভাবেই হয়েছিল। আবার একই সময়ে, দক্ষিণ গোলার্ধের কোনো এক স্থানে আরেকটি দীর্ঘ বিস্ফোরণ ঘটে যার প্রমাণ দেয় অ্যান্টার্ক্টিকার হিমবাহ। ১১০৮ থেকে ১১১০ সালের মধ্যে এই অগ্নি উৎপাতগুলো মারাত্মকভাবে বায়ুকে দূষিত করে দেয়। এর ফলেই ১১১০ সালে চাঁদ দেখা যায়নি পৃথিবী থেকে। চাঁদের অদৃশ্য হওয়ার পেছনে আরও অনেক কারণ থাকলেও, এটিই সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য প্রমাণ। এই গবেষণা প্রতিবেদনটি নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়।
