রাজ্য বা সাম্রাজ্য শাসনে পুরুষের মতো নারীরাও সংখ্যায় কম হলেও ক্ষমতায় এসেছেন। ক্ষমতা দখল করতে উচ্চাকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা, কৌশল তো বটেই অনেক সময় ছলচাতুরি, কিছু ক্ষেত্রে ক্ষমতার জন্য নির্মম ও রক্তাক্ত অভিযানেও যেতে হয়েছিল তাদের। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, মিশরের তিন হাজার বছরের ইতিহাসে ১৭০ জন ফারাওয়ের মধ্যে সাত জন ছিলেন নারী। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে অইতিহাসিকেরা একমত নন। কারণ, অনেক নারী শাসকের নামই ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে গিয়েছে। যাই হোক ওই ৭ জন নারী শাসকের মধ্যে দ্বিতীয় জন হলেন হাতশেপসুত।

প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে ফারাওদের রাজত্বকাল ছিল বিভিন্ন রাজবংশের শাসনে ভাগ করা। সেই ইতিহাসের আঠারোতম রাজবংশের বিখ্যাত রাজা ছিলেন প্রথম টুথমিস। তারই প্রধান মহিষী আহমেস-এর কন্যা হাতশেপসুত। দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমতী হাতশেপসুত ছিল রাজার সবচেয়ে প্রিয়। টুথপিসের দুই ছেলে রাজ্য পরিচালনায় বাবাকে সহায়তা করলেও তারা দুজনই রাজার জীবিত অবস্থায় অল্প বয়সে মারা যায়। ফলে ভগ্নস্বাস্থ্য টুথমিস রাজকাজে সাহায্যের জন্য তার প্রিয় কন্যা হাটসেপসুটসকে বেছে নেন। কিন্ত সেই সময় মিশরে নিয়ম ছিল কোনো মহিলা এককভাবে সিংহাসনে বসতে পারবে না। কিন্তু হাতশেপসুত সেই নিয়ম ভেঙেছিলেন। হাতশেপসুতের বিয়ে হয়েছিল সৎভাই দ্বিতীয় থুতমোসের সঙ্গে। (ভাই-বোনের মধ্যে বিয়ে প্রাচীন মিশরে ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা)

দ্বিতীয় থুতমোস রাজা হলেও তার পাশাপাশি থেকে রাজ্য শাসন করত হাতশেপসুত। কিন্তু দ্বিতীয় থুতমোসের মৃত্যুর পর রাজপরিবারে আবার একই প্রশ্ন ওঠে, কে পরবে রাজার মুকুট? শাসকপ্রার্থী তৃতীয় থুতমোস হলেও তখন তার বয়স মাত্র ৩ বছর। তাই তার হয়ে মিশরের সিংহাসনে বসেন হাতশেপসুত। সিঙ্ঘাসনে বসেই তার প্রথম লক্ষ্য ছিল নিজেকে পূর্ণাঙ্গ এবং সার্বভৌম ফারাও হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। রাজা হলেও একইসঙ্গে মুকুট ধরে রাখা আর রাজ্যের সকলের শ্রদ্ধা পাওয়া তার জন্য কঠিন পরীক্ষা ছিল। বিশেষ করে একজন মহিলা হয়েও মিশরীয়দের মনে রাজার স্থান পাওয়ার জন্য যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। মিশরীয়রা রাজা হিসেবে কোনো নারীকে মেনে নিতে রাজি ছিল না। হাতশেপসুত এই সমস্যারও সমাধান করতে পুরুষের বেশে রাজ্য শাসন করতে শুরু করলেন, বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সভাগুলোতে তিনি পুরুষদের পোশাক আর নকল দাড়ি পরতেন। ধীরে ধীরে তিনি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠলেন।

তবে এই পুরুষালী বেশভূষা বা নকল দাড়ির জন্য তিনি ইতিহাসে বিখ্যাত হননি। তিনি ছিলেন মিশরের সবচেয়ে সফল শাসকদের একজন, আর অন্যান্য নারী শাসকদের চেয়ে তার রাজত্বকাল ছিল লম্বা। প্রায় ২২ বছর রাজত্ব করেছেন। নতুন নতুন রাজ্যজয়ের পরিবর্তে রাজ্যকে সমৃদ্ধ করাই ছিল তার লক্ষ্য। এছাড়া রাজকীয় স্থাপত্য, সমাধি, মন্দির তৈরিতে তার মনোযোগ ছিল। তার সময়ে তৈরি স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল কর্নাক মন্দির। মিশরের লাক্সারে নীলনদের তীরে অবস্থিত এই মন্দিরে সুউচ্চ ওবেলিস্ক রয়েছে, মন্দিরের প্রবেশদ্বারের একজোড়া ওবেলিস্কের একটি এখনও হুবহু টিকে আছে। সুদীর্ঘ এই ওবেলিস্কগুলিতে লাল গ্রানাইট পাথর দিয়ে খোদাই করা হয়েছে বিভিন্ন ছবি বা চিহ্ন। হাতশেপসুতের তৈরি সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থাপনা হলো দের-আল-বাহরি উপত্যকায় অবস্থিত মন্দিরটি, যা হাজার বছর পরের গ্রিক স্থাপত্যকেও হার মানায়। এর আসল নামের বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘পবিত্রের মধ্যে পবিত্র স্থান’। একে পৃথিবীর অন্যতম আশ্চর্য স্থাপত্য হিসেবে ধরা হয়। এখানেই হাতশেপসুতের সমাধিও রয়েছে। মন্দিরের দেয়ালে এই পরাক্রমশালী নারীর জন্মের সেই পৌরাণিক কাহিনী খোদাই করা আছে, যেখানে হাতশেপসুতকে বলা হয়েছে মহাদেবতা আমুনের কন্যা।

তবে হাতশেপসুতের সাফল্য শুধুমাত্র স্থাপত্যশৈলীতেই সীমাবদ্ধ ছিলনা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও তিনি সমানভাবে সফল ছিলেন। এক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ ছিল পান্ট যাত্রা। ২০০ বছর আগে ভেঙে যাওয়া বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে অষ্টাদশ রাজবংশের সম্পদ গড়ে তোলার সুযোগ তৈরি করেন হাতশেপসুত। পান্ট বর্তমান ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া এবং সোমালিয়ার কাছাকাছি লোহিত সাগরের উপকূলে অবস্থিত একটি স্থান। এরপর হাতশেপসুতের কল্যাণে পাণ্টের সঙ্গে মিশরের বহু বছর বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। পান্ট থেকে লোবান, গন্ধরস, সোনাসহ অনেক দুর্লভ বাণিজ্যিক পণ্য মিশরে নিয়ে আসা হয়। হাতশেপসুতের অভিযাত্রীরা পান্ট থেকে ৩১টি গন্ধরসের গাছ নিয়ে আসেন। বিদেশ থেকে গাছ এনে রোপণের চেষ্টার এটাই প্রথম রেকর্ড। আর লোবান গুড়ো করে হাতশেপসুত তৈরি করতেন চোখের কাজল। হাতশেপসুত বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্য যেকোনো রাজার চেয়ে সফল ছিলেন। তার এই সফলতা মৃত্যুর আগপর্যন্ত বহাল ছিল।

হাতশেপসুতের মৃত্যু হয় সিংহাসনে আরোহণের প্রায় দু’যুগ পর। ততদিনে তৃতীয় থুতমোস বড় হয়েছেন। এবার তিনি রাজ্যের শাসনভার হাতে নেন। ইতিহাসবিদদের মতে, তৃতীয় থুতমোস সম্ভবত হাতশেপসুতের প্রতি হিংসাপরায়ণ ছিলেন, এর কারণ হতে পারে তার জায়গায় বসে রাজ্য শাসনের কারণেই। তাই ক্ষমতায় আসার পর তৃতীয় থুতমোস তার কীর্তিগুলো মুছে ফেলতে সচেষ্ট হন। তিনি এবং তার পুত্র দ্বিতীয় আমেনহোতেপ হাতশেপসুতের বিভিন্ন কীর্তিকে নিজের বলে চালিয়ে দিতেও চেষ্টা করেন। অনেকের মতে, এটা ছিল মিশরে নারীদের ফারাও হওয়া থেকে বাঁধা দেওয়ার এবং তাদের ক্ষমতা হ্রাসের ব্যর্থ চেষ্টা। তবে তারা পুরোপুরি সফল হতে পারেননি, এর কারণ হাতশেপসুতের দূরদর্শীতা। এরকম কিছু যে হতে পারে তা হাতশেপসুত বুঝেছিলেন। তাই তিনি সমস্ত স্থাপনা, সমাধি, ওবেলিস্কসহ বিভিন্ন জায়গায় নিজের কীর্তির অসংখ্য প্রমাণ রেখে যান। এত নিদর্শন চাইলেও ইতিহাসের পাতা থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলা কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
