দুনিয়ায় এমন বহু জায়গা আছে, যেগুলির সঙ্গে এমন রহস্য জড়িয়ে আছে যাতে ভয় থাকলেও তার আকর্ষণ এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ঠিক তেমনই একটি জায়গা হল রাজস্থানের সিহনি গ্রাম। এমনিতেই রাজস্থানে অনেকগুলি দুর্গ রয়েছে যেগুলির সঙ্গে ভীতিকর রহস্য জড়িয়ে রয়েছে। কেবল রাজস্থানের দুর্গ আর সংস্কৃতি নয়, ইতিহাস, মরুভূমির বৈশিষ্ট্য আর নানান লোককথায় রহস্যে আবৃত এই রাজ্য। রাজস্থানের কুলধারা গ্রাম এবং ভানগড় ফোর্টের ভুতুড়ে গল্পের কথা অনেকেই জানেন। তবে রাজস্থানের আরেকটি এমন স্থান রয়েছে, যার রহস্যের টানে ছুটে যান মানুষ।

মরুভূমি ঘেঁষা বারমের শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে সিহনি গ্রামে অবস্থিত অভিশপ্ত কিরাডু মন্দির। মন্দিরের ভাস্কর্য শুধু শিল্পী নয় নজর টানবে যে কোনো মানুষেরই। এই মন্দিরের ভাষ্কর্যের সঙ্গে খাজুরাহো মন্দিরের মিল থাকায় কিরাডু ‘রাজস্থানের খাজুরাহো’ নামেও পরিচিত৷ তবে সন্ধার পর কেউ এই মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেন না। গ্রামের বাসিন্দাদের বিশ্বাস, সূর্য অস্ত যাওয়ার পর কেউ যদি এই মন্দিরে প্রবেশ করে তাহলে তার মৃত্যু অবধারিত। আর যদি কেউ প্রাণে বেঁচেও যায় তাহলেও সে সশরীরে ফিরে আসার আগেই পাথরের মূর্তি হয়ে যায়!

কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, ১২ শতকে পারমার রাজবংশের সোমেশ্বর নামে এক রাজা এখানে রাজত্ব করতেন। তাঁর আমলেই ভারতে তুর্কি অভিযান ঘটে। কিরাডু এই আক্রমণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সোমশ্বর এর পর থেকে বিদেশি আক্রমণের ভয়ে ভীত হয়ে পড়েন। এবং তিনি এক সন্ন্যাসীর শরণাপন্ন হন। সন্ন্যাসীর সঙ্গে এক শিষ্য ছিলেন। তিনি সেই শিষ্যকে কিরাডুতে রেখে যান। ক্রমে কিরাডু তুর্কি আক্রমণের ক্ষতগুলিকে অতিক্রম করে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু কিরাডুর মানুষ ওই শিষ্যের কথা বেমালুম ভুলে যায়। একসময়ে এই শিষ্য অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক কুম্ভকারের স্ত্রী ছাড়া আর কেউ তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এমন সময়ে সন্ন্যাসী ফিরে আসেন। এবং তিনি তাঁর শিষ্যের প্রতি কিরাডুবাসীর অবহেলা দেখতে পান। ক্রুদ্ধ সন্ন্যাসী এই মর্মে অভিশাপ দেন যে, এই মানবিকতাহীন জনপদের সর্বনাশ হবে। তাঁর অভিশাপেই নাকি গোটা কিরাডু পাথরে পরিণত হয়। কেবল সেই কুম্ভকার-পত্নী জীবিত থাকেন। সন্ন্যাসী তাঁকে সন্ধের আগে কিরাডু ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দেন। এবং যাওয়ার পথে পিছনে তাকাতে নিষেধ করেন। সেই মহিলা সন্ন্যাসীর আজ্ঞা পালন করেন। কিন্তু জনপদের সীমান্তে পৌঁছে কৌতূহলবশত পিছনে ফিরে তাকান। দেখতে পান, গ্রামবাসীরা সকলেই পাথর হয়ে গিয়েছে। এই তাকনোর সঙ্গে সঙ্গে তিনিও পাথরে পরিণত হন।

এই কাহিনির কোনও বাস্তব প্রমাণ অবশ্যই নেই। কিন্তু লোকবিশ্বাসের এতটাই গভীরে শিকড় গেড়ে রয়েছে যে, একে প্রায় ইতিহাসের মর্যাদা দেন স্থানীয় মানুষ। তাঁদের ধারণা, সূর্যাস্তের পরে আজও ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে সন্ন্যাসীর অভিশাপ। পাথরের মূর্তিরা ক্রমে প্রাণ ফিরে পায়, মরুভূমির শুকনো হাওয়ায় ভাসতে থাকে পাথরের দীর্ঘশ্বাস। প্রেতলোক আর ইহজগতের সীমানা আবছা হয়ে যায় কিরাডুতে। নেমে আসে ছায়ামূর্তির দল। আজও তাই সন্ধের পরে কিরাডুর অনুপম মন্দিরগুলি জনশূন্য থাকে।

রাজস্থানের খাজুরাহো মন্দির নামে পরিচিত কিরাডু মন্দিরটি মারু-গুর্জরা স্থাপত্যের এক নিদর্শন। আবহাওয়ার কারণে মন্দির কমপ্লেক্সের বেশ কিছু অংশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। তবে বেশ কিছু সাহিত্যে কিরাডুর বিষ্ণু মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, খুব কম লেখাতেই মন্দির কমপ্লেক্সের মধ্যে বিদ্যমান অন্যান্য মন্দিরের বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে। কিরাডুর স্থাপত্য এবং বর্তমান কাঠামোগত অবস্থার কথা গবেষকদের নানা লেখা থেকে জানা যায়। কিরাডু মন্দিরটি স্থাপত্য খাজুরাহো এবং কোনার্ক মন্দির ছাড়া আর কোথাও দেখা যায়না। মন্দির, স্তম্ভ ইত্যাদির দেয়ালে এত পরিশীলিত, কল্পনাপ্রবণ এবং এমন শৈল্পিক পাথর খোদাই দেখতে পাবেন না। এগুলি মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের সংস্কৃতি এবং নীতির উদাহরণ দেয়। বলা হয় যে, এখানে ১০৮টি মন্দির ছিল কিন্তু এখন মাত্র পাঁচটি মন্দির অবশিষ্ট রয়েছে। সেটি হল সোমেশ্বরকে উৎসর্গীকৃত শিব মন্দির। এর শিখর ভেঙে পড়েছে এবং হল-মণ্ডপটি নেই, তা সত্ত্বেও এই মন্দিরটি পুরনো গৌরব ও অইতিহ্যেরব প্রতীক।

বেঁচে থাকা ধ্বংসাবশেষের মধ্যে সবচেয়ে বড়টি ছিল মূল মন্দির। বিভিন্ন স্থানে ডাইনোসরের মতো দেখতে এবং ড্রাগনের মুখের মতো খোদাই করা মূর্তি রয়েছে। কামসূত্রের বিভিন্ন অবস্থানের ভাস্কর্য সমস্ত মন্দিরের লিন্টেল, বিম, খিলান এবং দেয়ালগুলিতে অলংকৃত করা। মন্দির কমপ্লেক্সে সংস্কৃত বা কোনও উপভাষায় কিছু শিলালিপি সহ একটি দেয়ালও ছিল বলে মনে করা হয়।
