আজ থেকে ৭০ বছর আগে এদেশে কুস্তিগীর বলতে শুধু পুরুষ খেলোয়াড়। কিন্তু গত শতকের চারের দশকেই একজন নারী কুস্তিগীর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।যদিও কুস্তির ময়দানে বেশ কয়েকটি লড়াইতে নজির গড়লেও তিনি হারিয়ে যান।উত্তর প্রদেশের আলিগড় শহরের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। স্থানীয় সংবাদপত্রে তাকে ‘আলিগড়ের আমাজন’ নামে ডাকা হত। সংবাদপত্রেই তাঁর সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, তিনি একবার কারও দিকে একবার তাকানো মাত্রই তার মেরুদণ্ড বেয়ে যেন ঠান্ডা ঘাম নেমে আসতো। সেই সময় তাঁর ওজন, উচ্চতা, ডায়েট সবই খবরের পাতায় উঠে এসেছিল। তৎকালীন সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, তার ওজন ছিল ১০৮ কেজির মতো। তাঁর উচ্চতা চিল ৫ ফুট ৩ ইঞ্চি। এও জানা যায়, তাঁর প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় থাকতো ৫.৬ লিটার দুধ, ২.৮ লিটার স্যুপ, ১.৮ লিটার ফলের রস, প্রায় ১ কেজি খাসির মাংস ও বাদাম, আধা কেজি মাখন, ৬টি ডিম, দুটি বড় রুটি এবং দু’প্লেট বিরিয়ানি। দেশের প্রথম এই নারী কুস্তীগিরের নাম হামিদা বানু।

হামিদা বানু ১৯৫৪ সালে মুম্বাইতে রাশিয়ান কুস্তিগীর ভেরা চিস্টিলিনকে পরাজিত করেছিলেন। সেই বছরই হামিদা বানুর কুস্তি লড়তে ইউরোপ যাওয়ার কথা ছিল। তাঁর ইউরোপ যাত্রা নিয়ে সংবাদপত্রে ব্যাপক প্রচার হয় কিন্তু এরকম সময়েই কুস্তির জগৎ থেকে হারিয়ে যান হামিদা বানু। তিনি শেষ পর্যন্ত ইউরোপ গিয়েছিলেন কিনা, সঠিক জানা যায়না। তাছাড়া ভারতের প্রথম নারী কুস্তিগীরের ভাগ্যে শেষমেশ কী ঘটেছিল তাও সঠিক ভাবে জানা যায়না। তবে তৎকালীন কিছু সংবাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘কুস্তিতে হারাতে পারলে প্রতিপক্ষকে বিয়ে করবেন’- হামিদা বানুর এমন ঘোষণা আসে ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তখন তাঁর বয়স প্রায় ৩০। এই ধরনের প্রতিবেদন যখন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছিল তার কিছুদিনের মধ্যেই হামিদা বানু দু’জন পুরুষ কুস্তিগীরকে পরাজিত করেছিলেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন পাঞ্জাবের পাতিয়ালার এবং অন্যজন কলকাতার। একই বছরের মে মাসে হামিদা বানু তৃতীয় লড়াইয়ের জন্য যান পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের ভাদোদরা (তৎকালীন বরোদা)তে। জানা যায়, হামিদা বানুর ভাদোদরা আসার খবরে পুরো শহর জুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এলাকার ছোট ছোট যানবাহনে পোস্টার সাঁটিয়ে, ব্যানার টাঙিয়ে হামিদার আগমনের খবর প্রচার করা হয়।

ভাদোদরার সেই কুস্তির লড়াই সম্পর্কে জানা যায়, হামিদা বানুর লড়াই করার কথা ছিল ছোটে গামা পালোয়ান (হিন্দিতে পেহেলওয়ান) এর সঙ্গে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই পালোয়ান লড়াই থেকে সরে আসেন এই বলে যে, তিনি কোনো নারীর সঙ্গে কুস্তি করবেন না। এরপর হামিদার সঙ্গে কুস্তি লড়ার পরবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বাবা পালোয়ান। ওই লড়াই সম্পর্কে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস ১৯৫৪ সালের ৩ মে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, লড়াইটি মাত্র ১ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল। তার মধ্যেই জিতে যান নারী কুস্তিগীর হামিদা বানু। ভাদোদরার লড়াইয়ের আরও দশ বছর আগে থেকেই কুস্তির মাঠে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন হামিদা বানু। ১৯৪৪ সালে মুম্বাইয়ের ক্রনিকল পত্রিকার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শহরের একটি স্টেডিয়ামে হামিদা বানু ও গুঙ্গা পালোয়ানের মধ্যে লড়াই দেখতে প্রায় কুড়ি হাজার মানুষ হাজির হয়েছিল। কিন্তু, গুঙ্গা পালোয়ান কয়েকটি আশ্চর্য দাবি করে বসায় শেষ মুহূর্তে লড়াই বাতিল করা হয়। তাঁর দাবি ছিল আরও বেশি টাকা এবং প্রস্তুতির জন্য তাঁকে আরও সময় দিতে হবে। সেই লড়াই না হওয়ায় বিক্ষুব্ধ দর্শক স্টেডিয়াম ভাঙচুর করেছিল।

প্রসঙ্গত, হামিদা বানু যেবার বরোদায় কুস্তি লড়তে যান, তার আগেই তিনি ৩০০-রও বেশি লড়াই জিতেছেন বলে দাবি করেন। রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তিনি দিনে ন’ঘণ্টা ঘুমাতেন এবং ছ’ঘণ্টা অনুশীলন করতেন। জানা যায় যে, তৎকালীন রক্ষণশীল পরিস্থিতির কারণে তিনি নিজের বাসস্থান উত্তর প্রদেশের মির্জাপুর ছেড়ে আলিগড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। মহেশ্বর দয়াল হামিদা বানুর উপর তাঁর বইতে লিখেছেন, হামিদা বানু উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বেশকিছু কুস্তিতে অংশগ্রহণ করেন এবং দূর-দূরান্তে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি এও লিখেছেন, হামিদা বানু একজন পুরুষ কুস্তিগীরের মতোই লড়াই করতেন। তবে, কয়েকজন এও বলেছেন যে, হামিদা পালোয়ান ও পুরুষ কুস্তিগীরদের মধ্যে একটি গোপন চুক্তি হত। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রতিপক্ষ পুরুষ কুস্তিগীর ইচ্ছাকৃতভাবে হারতো। আবার কুস্তির কারণে তাঁকে জনসমক্ষে তোপের মুখেও পড়তে হয়েছে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জনসমক্ষে কুস্তি লড়াই নিয়ে পুনে শহরে কুস্তি ফেডারেশন আপত্তি জানায়। ফলে পুরুষ কুস্তিগীর রামচন্দ্র সালুঙ্কের সঙ্গে একটি লড়াই বাতিল হয়ে যায়। একবার এক পুরুষ প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার পর দর্শকরা হামিদা বানুকে গালিগালাজ করে। তাঁকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়তে থাকে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশকে মাঠে নামতে হয়।

সমাজের পুরুষরা হামিদা বানুর কৃতিত্বকে উপহাস করলেও উর্দু নারীবাদী লেখক কুররাতুলাইন হায়দার হামিদা বানুর একটি ভিন্ন চিত্র আঁকেন নিজের ছোটগল্প ‘দালান ওয়ালা’তে। তিনি লেখেন, তার গৃহকর্মী ফকিরা মুম্বাইয়ে একটি কুস্তি খেলা দেখে ফিরে এসে বলেছিলেন, ‘সিংহী’কে কেউ হারাতে পারেনি। তবে কুস্তি ছেড়ে হামিদা জীবিকা নির্বাহ করতেন খামারের দুধ বিক্রি করে। যখন টাকা ফুরিয়ে যেত, তখন রাস্তার ধারে বসে বাড়িতে তৈরি খাবার বিক্রি করতেন হামিদা। কুস্তির ময়দানে খ্যাতনামা পালোয়ানদের পরাজিত করলেও, জীবনযুদ্ধে জিততে পারেননি হামিদা। সমাজের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা একসময়কার লড়াকু এই কুস্তিগীরের শেষ দিনগুলো কেটেছিল দুর্দশার মধ্য দিয়ে।
