বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর শাসকের কথা উঠলেই সবার আগে মাথায় আসে হিটলারের কথা। কারণ, গোটা বিশ্ব এখনো তার সংঘটিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু অনেকেই বলেন, হিটলার নয় তার চেয়েও ভয়ংকর এক শাসক ছিলেন। তারা উগান্ডার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইদি আমিনের কথা বলেন, যার নৃশংসতা সমস্ত সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। একসময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি নিজের নিষ্ঠুরতার নজির স্থাপন করেন। বিদ্রোহীদের ভয় দেখাতে জীবিত মানুষকে মাটিতে পুঁতে ফেলা কিংবা লাশ টুকরো করে কুমিরকে খাওয়ানোর মতো কাজ তার পক্ষে কোনো ব্যাপার ছিল না। তার শাসনামল অর্থাৎ ১৯৭১ থেকে ১৯৭৯ উগান্ডা এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে চলেছিল। তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং স্বৈরাচারী শাসন কায়েম করে গণহত্যা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, জাতিগত নিধন যেমন চালিয়েছিলেন পাশাপাশি উগান্ডাকে অর্থনৈতিক বিপর্যযয়ের তলানিতে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

তুঘলকি রাজত্ব কায়েমের উদ্দেশ্যেই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেনন জেনারেল ইদি আমিন। ক্ষমতা দখলের পর তিনি যে উপাধি গ্রহণ করেন তাতে তার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়। ‘হিজ এক্সলেন্সি প্রেসিডেন্ট অব লাইফ, ফিল্ড মার্শাল আলহাজ ডক্টর ইদি আমিন বিসি, ডিএসও, এমসি, লর্ড অব অল দ্য বিস্টস অব দ্য আর্থ অ্যান্ড ফিসেস অব দ্য সি অ্যান্ড কনকুয়েরর অব দ্য ব্রিটিশ ইম্পিয়ার ইন আফ্রিকান জেনারেল অ্যান্ড উগান্ডা ইন পার্টিকুলার।’ যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘উগান্ডা তথা আফ্রিকায় ব্রিটিশ আধিপত্য ক্ষুণ্নকারী, দুনিয়ার সব পশু এবং সাগরের মৎস্যকুলের অধীশ্বর মহামান্য আজীবন প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আলহাজ ডক্টর ইদি আমিন ভিসি, ডিএসও এমসি’।

সেনাপ্রধান থাকাকালীন কিংবা তার আগে থেকেই তিনি ছিলেন দেশের শীর্ষ দুর্নীতিবাজের একজন। কেউ কেউ বলেন, তিনি সোনা আর কফি চোরাচালান ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ইদি আমিন এক সময় ছিলেন হেভিওয়েট বক্সার। মেধার চেয়ে পেশিশক্তির ওপর ছিল তার নির্ভরতা। ক্ষমতায় এসে তিনি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর স্বদেশিদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। এর আগে উগান্ডার ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল মূলত ভারতীয় ও ব্রিটিশদের অধীনে। রাতারাতি তিনি উগান্ডা থেকে ভারতীয় ও ব্রিটিশদের তাড়িয়ে দেন। ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশরা উগান্ডাবাসীর ওপর যে অপমানজনক ব্যবহার করে, ইদি নানাভাবে তার বদলা নেন। তিনি একবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে তার জন্য জুতা সরবরাহের অনুরোধ করেন। পালকিতে করে তিনি শ্বেতাঙ্গদের ঘাড়ে চড়েও সুখ মেটাতেন। নারী লোলুপ হিসেবে ইদি আমিনের বদনাম ছিল দেশজুড়ে। তার স্ত্রীর সংখ্যা ছিল প্রায় এক ডজন। এক সুন্দরীকে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে বসান। তার পওপর প্রেসিডেন্ট ইদি আমিনের কুনজর পড়লে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচেন।

ইদি আমিন তার শাসনকালে অসংখ্য এশীয় ও স্থানীয় উপজাতিদের ওপর অত্যাচার চালান। সন্দেহভাজন বিরোধীদের ধরে এনে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নির্যাতন চালাতেন। কক্ষের ভিতর বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার বা ইলেকট্রিক শক দেওয়ার মতো ভয়ঙ্কর পদ্ধতিতে মানুষ হত্যা ছিল তার আমলের নিয়মিত ঘটনা। তবে যা সবচেয়ে বিভীষিকাময় তা হল, শত্রুদের মাংস খাওয়া। অনেকেই তাকে ‘উগান্ডার কসাই’ বলে ডাকতেন। লাশের সঙ্গে কথা বলা বা তাদের পাশে ঘুমিয়ে পড়া ছিল তার অমানবিক আচরণের অংশ। ইদি আমিনের নির্দেশে প্রায় ৩ থেকে ৫ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি সামরিক বাহিনীর সাহায্যে যেমন বিরোধীদের নির্মূল করেছিলেন, তেমনি বিচার ছাড়াই হাজার হাজার মানুষকে হত্যা, অনেককে গুম এবং নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। উগান্ডা থেকে এশিয় ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রায় ৬০ হাজার মানুষকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে উগান্ডার জনগণের মধ্যে বিতরণ করেন, যা দেশের অর্থনৈতিক পতনের অন্যতম কারণ হয়। তবে এই ভারতীয় ও এশিয় বংশোদ্ভূতরাই ছিল উগান্ডার অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। তাদের বিতাড়িত করার ফলে উগান্ডার অর্থনীতি দ্রুত ভেঙে পড়ে, মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়, খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়, এবং কালোবাজারি ছড়িয়ে পড়ে।

ছয় স্ত্রী, ৫০-র বেশি রক্ষিতা থাকার পরও এমনকি তাঁর যৌন লালসার হাত থেকে রেহাই মেলেনি তার বোনেরও। এই সবকিছু ছাপিয়ে বারবার চর্চায় এসেছে ইদি আমিনের যৌন খিদের গল্প। ক্ষমতায় এসেই দেশের পুলিশ বাহিনীকে ভেঙে দেন তিনি। তৈরি করেন নিজস্ব একটি কিলার ফৌজ। তাঁদের কাজই ছিল তরুণী মেয়েদের অপহরণ করে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে তুলে আনা। একরাতে একাধিক তরুণীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হতেন উগান্ডার প্রেসিডেন্ট। তাঁর যৌন লালসার শিকার হয়েছে বহু নাবালিকা। প্রতিবাদ করলেই পরিবার শুদ্ধ গুম খুন করা হত তাঁদের। এছাড়া আরও একটি মারাত্মক অভিযোগ ছিল ইদি আমিনের বিরুদ্ধে। তিনি নাকি মানুষের মাংস খেতেন। প্রেসিডেন্ট প্যালেস সংলগ্ন একটি বিশেষ ঘরে ফ্রিজারে রাখা হত সেই নর মাংস। এই মাংস রান্না করার জন্য বিশেষ রাঁধুনিও নিয়োগ করেন তিনি। তবে একদিন বিষয়টি জানতে পারেন তাঁর তৃতীয় স্ত্রী নোরা। ওই ঘরে ঢুকে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন তিনি। জ্ঞান ফেরার পর তিনি পত্রপাট সেখান থেকে চম্পট দেন।
