রহস্যঘোরা এই পৃথিবীর কখন কোথায় কি ঘটবে তা নিশ্চত করে বলা মুশকিল। আমরা রহস্যময় পৃথিবীর অনেক বিস্ময়কর ঘটনার কথা শুনেছি। দেখেছি ভাবনার অতীত নানা অদ্ভুত অনেক ঘটনা। এখান আমরা জানবো অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলের প্রদেশ নর্দান টেরিটোরিতে অবস্থিত ‘আয়ারস রক’ পাহাড়ের কথা যেটি আঞ্চলিক ভাষায় ‘উলুরু’ নামে পরিচিত। ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই পাহাড়টির প্রস্থ ২.৪ কিলোমিটার এবং উচ্চতা ৩৪৮ মিটার। পাহাড়টির অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৬৩ ফুট ওপরে। অনেকটা ডিমের মতো দেখতে পাহাড়টি পুরোপুরি একটি শিলা বা প্রস্তর খণ্ড। উল্লেখ্য, পাহাড় প্রকৃতির অন্যতম সৌন্দর্য যা রহস্যময়ও বটে। প্রত্যেক পাহাড়ের স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলি এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়কে আলাদা করে রাখে। তেমনই এক পাহাড় আয়ারস রক যা অন্যান্য পাহাড় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

গিরগিটি রং বদলায় এটা তো আমরা সবাই জানি; কিন্তু কখনও কখনও পাহাড়ও রং বদলায়। আয়ারস রক পাহাড়ের প্রধান বিশেষত্ব হচ্ছে, এটি ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। সকালে এক রঙ তো দুপুরে আরেক রঙ আবার সন্ধ্যায় বা রাতে দেখা যায় অন্য আরেকটি রূপ। তাই মানুষ এই পাহাড়ে নাম দিয়েছে জাদুর পাহাড়। আয়ারস রক পাহাড়টির স্বাভাবিক রঙ কালচে কিন্তু সকালে সূর্যের রশ্মি পাহাড়ের গাঁয়ে পড়লে মনে হয় পাহাড়ের গায়ে আগুন লেগে গিয়েছে। বেগুনি এবং গারো লাল রঙের আলোর বিচ্ছুরণ ঘটতে থাকে পাহাড় থেকে। এছাড়া দিনের বিভিন্ন সময় চলে এই রঙ বদলের খেলা যে কারণে মনে হয় পাহাড়টি যেন সারাক্ষণ রং নিয়ে খেলছে। পাহাড়টির রঙ প্রথম দিকে কারও কাছে মনে হয় হলুদ, এরপর মনে হয় কমলা পরে লাল মাঝে মাঝে বেগুনি এবং কখনো বা ঘুমোট কালো রং বলে মনে হয়। রঙের এই রহস্য নিঃসন্দেহে যে কাউকে মুগ্ধ করবে।

রহস্যে ঘেরা অদ্ভুত এই পাহাড়টি আসলে একটি বিরাট প্রস্তরখন্ডে আবৃত। এর গঠন কাঠামো ভারী অদ্ভুত। আসলে সূর্যের আলোর আপাতন কোণের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে এই পাহাড়ের রং পরিবর্তন হতে থাকে। পাহাড়টির এমন অদ্ভুত রঙ বদলানোর রহস্য নিয়ে মতবিরোধ আছে অনেকের মধ্যেই। ধারণা করা হয়, রহস্য লুকিয়ে আছে পাহাড়টির ভৌগোলিক অবস্থানের উপর। অনেকে বলেন, পাহাড়ের নীচে এক শক্তিশালী ম্যাগনেটিক ফিল্ড আছে যার কারণে বিভিন্ন কোণে সূর্যের আলো পাহাড়টির উপরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের রঙবদল হচ্ছে। অনেক কল্পকাহিনীও প্রচলিত আছে এই পাহাড়টিকে নিয়ে। স্থানীয়রা ভাবেন, এই পাহাড়ে আগে জাদুকররা বাস করত তারাই জাদু মন্ত্র দিয়ে এমনটি করে গিয়েছে। তবে এই পাহাড়ের রং বদলানোর আসল রহস্য কারো পক্ষে এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে, বাইরে থেকে প্রতিনিয়ত বহু পর্যটক আসে পাহাড়টিকে দেখতে। তাই অস্ট্রেলিয়া সরকার পরিদর্শনের সুবিধার্থে পাহাড়ের আশেপাশে ৪৮৭ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে মাউন্ট দ্য ন্যাশনাল পার্ক গড়ে তুলেছে যেখানে দূর থেকে ঘুরতে আসা দর্শকরা খুব সহজেই আয়ারস রকের রূপসৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী মানুষগুলোর জন্য এটি অত্যন্ত প্রিয় একটি জায়গা। সারা বছরই পর্যটক ভিড় করে থাকেন আলোর এই খেলা চোখে দেখতে। পার্কটির নাম ‘মাউন ওগলাস ন্যাশনাল’ পার্ক। অন্য আরেকটি নাম হল ‘কাতা তুজা’। তবে স্থানীয়রা একে পবিত্র পাহাড় মনে করায় পাহাড় পরিদর্শন খুব একটা পছন্দ করেন না। ১৯৭৫ সালে আয়ারস রক পাহাড় থেকে ১৫ কিলোমিটারের দূরত্বে একটি বিমানবন্দর স্থাপন করা হয়। পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার জন্য নির্মাণ করা হয় ‘ইউলারা’ রিসোর্ট। সেই সঙ্গে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে দেখারও সুযোগ রয়েছে।

উলুরু সর্বপ্রথম বিশ্বের নজরে আসে ১৮৭৩ সালের ১৯শে জুলাই। ব্রিটিশ অষ্ট্রেলিয়ান সমীক্ষক উইলিয়াম গোজ জায়গাটিকে আবিষ্কার করেন। তিনি তৎকালীন সাউন অষ্ট্রেলিয়ার সরকার প্রধান স্যার হেনরি আয়ার্সে নামে এটিকে আয়ার্স রক হিসেবে নামকরন করেন। উল্লেখ্য, উত্তর চীনের গানসু প্রদেশের লিনজে জেলায় ৪০০ বর্গ কিলিমিটার এলাকাজুড়ে রয়েছে রামধনু পর্বত বা রেনবো পাহাড়। ভূবিজ্ঞানীদের মতে, বহু বছর ধরে টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে পর্বতের গায় এমন রামধনুর সাত রং ফুটে উঠেছে। টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষের ফলে ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছিল শিলাস্তর। শিলাস্তরে ছিল প্রচুর খনিজ পদার্থ, রঙিন সিলিকা সহ নানা উপাদান। বহু বছর ধরে ঋতু পরিবর্তন, ঝড়, বৃষ্টি, তুষারপাত, বিভিন্ন রকম রাসায়নিক বিক্রিয়ায় রূপ পরিবর্তন করতে করতে তৈরি হয়েছে এই রেইনবো মাউন্টেন। হিমালয়ের অনেক আগেই এই পাহাড় তৈরি হওয়া শুরু হয়েছিল। ভূবিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, পাহাড়টি তৈরি হতে সময় লেগেছে প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ বছর।
