পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষায় শিক্ষা
কৌশিক সরকার
কেন্দ্রের নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতিতে বলা হয়েছে, পঞ্চম শ্রেণি, সম্ভব হলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষা/স্থানীয় ভাষায় পড়ানোর ব্যবস্থা করা হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে ফের দানা বেঁধেছে বিতর্ক। অনেকেই বলছেন, তবে কি জাতীয় স্তরে ফের অতীতে এরাজ্যের জ্যোতি বসুর সরকারের মতো ইংরেজি বিসর্জনের ব্যবস্থা করা হলো ? ১৯৯২ সালে সামান্য কিছু পরিবর্তন বাদে,১৯৮৬ সালে রাজীব গান্ধীর শিক্ষা নীতির পর ৩৪ বছর বাদে পরিপূর্ণ একটি শিক্ষানীতি গ্রহণ করল নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
ইতিহাস কি বলে ?
স্বাধীনতার পরে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার হাল খতিয়ে দেখতে বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। তার মধ্যে বহু চর্চিত কোঠারি কমিশনের সুপারিশও ছিল পঞ্চম পর্যন্ত ইংরেজি না পড়ানো। কোঠারি কমিশনের অন্যতম বক্তব্য ছিল, ইংরেজি উপযুক্তভাবে পড়ানোর জন্য দেশে যে সংখ্যক প্রশিক্ষিত শিক্ষক দরকার তার ঘাটতি রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের গড়া কমিশনগুলির রিপোর্টগুলির ভিত্তিতে ১৯৬৮ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হয় সংসদে। সেখানেও ওই ব্যবস্থা গ্রহণের কথাই বলা হয়। তার ভিত্তিতে ১৯৭৫ সালের মধ্যে বেশিরভাগ দেশিয় রাজ্যেই প্রাথমিকে দ্বিতীয় ভাষার ব্যবহার বন্ধ করে।
এ রাজ্যে স্বাধীনতার সময়েও কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি পড়ার ব্যবস্থা চালু ছিল। যদিও তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী হরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে যে কমিটি গঠন করা হয়, সেই কমিটির সুপারিশে বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে এরাজ্যে প্রাথমিকে বন্ধ হয় ইংরেজি পড়ানো। কংগ্রেস আমলেই তা তুলে দেওয়া হলেও অভিভাবকদের চাপে ১৯৬৪ সালে তৃতীয় শ্রেণি থেকে ফের ইংরেজি পড়ানো চালু হয় এ রাজ্যে।
প্রাথমিক শিক্ষাকে আরও বাস্তবানুগ করার উদ্দেশ্যে ১৯৭৪ সালে বিশ্বভারতীর বিনয় ভবনের অধ্যক্ষ অধ্যাপক হিমাংশু বিমল মজুমদারকে চেয়াীরম্যান করে একটি কমিটি গঠন করে রাজ্যের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার। যদিও বেশ কিছু সময় কাজ করতে পারেনি ওই কমিটি। জ্যোতি বসু ১৯৭৭ সালে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ওই কমিটিকে পুনর্গঠন করেন। ১৯৭৯ সালে হিমাংশু বিমল মজুমদারের কমিটিও পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি না পড়ানোরই সুপারিশ করে। তার ভিত্তিতেই পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি না পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় জ্যোতি বসুর সরকার। প্রায় ১৫ বছর বাদে ফের প্রত্যাহার করা হয় ওই সিদ্ধান্ত। নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য রাজ্যের বিগত বাম সরকার গঠন করে অধ্যাপক পবিত্র সরকার নেতৃত্বে একটি কমিটি।
প্রসঙ্গত, মুদলিয়ার কমিশন (১৯৫২-৫৩), ১৯৫৩ সালে দিল্লিতে ইংরেজি অধ্যাপকদের সম্মেলন এবং ১৯৫৬ সালে দিল্লিতে শিক্ষামন্ত্রীর সম্মেলনেও প্রাথমিকে ইংরেজি না পড়ানোর পক্ষেই সুপারিশ করা হয়েছিল।
পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তি
কেন্দ্রের নয়া শিক্ষানীতিতে অবশ্য পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়নি। বিষয় হিসেবে ইংরেজি থাকলেও অন্তত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষা বা স্থানীয় ভাষার মাধ্যমেই পড়ানোর কথা বলা হয়েছে। যার অর্থ, পঞ্চম পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যমের কোনো স্কুল থাকবে না।
সমস্যা এখানেই। কারণ এখন কলকাতা তো বটেই, গ্রামে গঞ্জেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। বাংলা মাধ্যমের ছাত্রছাত্রী যখন কমছে তখন ওই স্কুলগুলিতে বাড়ছে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা। এটা নিছক স্ট্যাটাস সিম্বল নয়, ভবিষ্যৎ শিক্ষা এবং কর্মজীবনে খানিকটা সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতেই ওই পথে হাঁটছেন অনেক অভিভাবকই। কারণ মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা এদেশে এখনো যথেষ্ট দুর্বল। এই পরিস্থতি গোটা দেশেই বাড়ছে এই প্রবণতা।
বিশেষজ্ঞ মহলের অনেকেরই বক্তব্য, বহু জাতির ভারতে মাতৃভাষার সংখ্যাও অনেক। কিন্তু এমন একটি দেশে ইংরেজি যোগাযোগের সাধারণ ভাষা। শুধু তাই নয়, ট্রান্সফারেবল জবেও যুক্ত বহু মানুষ। এছাড়াও বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজির গুরুত্বকে খাটো করলে তাতে আখেরে ক্ষতি।
বিপরীতের যুক্তি, স্বাধীনতার পর দেশ অনেকটা এগোলেও এখনো দেশের একটি বড় অংশের ছাত্রছাত্রীদেরই স্কুলে ধরে রাখতে এবং তাদের পুষ্টির জন্য মিড ডে মিলের ব্যবস্থা করতে হয় সরকারকে। তাদের অনেকের কাছেই ইংরেজি ভাষা একটি ভীতির কারণ। তাছাড়া জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, চিন, রাশিয়া, স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলো সহ বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই প্রাথমিকে মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষা দেওয়া হয়। তাদের তো অসুবিধা হচ্ছে না !
যারা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন তাদের বক্তব্য, প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের ও তো একটি ভাষা হিসেবে ইংরেজি শিখতে হচ্ছেই। তবে আর বিশেষ কি সুবিধা হলো তাদের ? আর তারা তো মাতৃভাষা বা স্থানীয় ভাষাতেই পড়ার সুযোগ পায়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তে যারা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছেন, তাদের ক্ষতি হবে।