শরীরের উপরিভাগ নারীর অবয়ব এবং নিচের অংশ মাছের শরীরের মতো দেখতে জলরাজ্যের অসম্ভব সুন্দর জলপরীদের অস্তিত্ব কি পৃথিবীতে আছে? ডায়নোসরের মতো মৎস্যকন্যারাও কি হাজার বছর আগে পৃথিবীতে বাস করতো? সত্যিই কি এই জলপরীরা জীবন্ত কোনো প্রাণী? ‘মারমেইড বা মৎস্যকন্যা অথবা জলকন্যা’ নামক প্রাণীটির প্রথম সূত্র মেরফোক বা মের্পিপলের গল্প। মেরফোক নামের রহস্যময় এই জলজপ্রাণীদের পুরুষ অবয়বের নাম মেরম্যান ও নারীদের বলা হয় মারমেইড। সমগ্র বিশ্বের সব লোককাহিনী ও পৌরাণিক কাহিনিতে কমবেশি মারমেইড তথা জলজগতের এই রহস্যময় প্রাণীটি আলোচনায় এসেছে। সেসবের প্রেক্ষিতে জানা যায়, মানুষ এবং মাছের বৈশিষ্ট্য নিয়ে সৃষ্ট এই প্রাণীটি দেখতে নারীর মতো। যার আছে কোমর অব্দি সোনালী চুল। শরীরের উপরিভাগ নারীদের মতো এবং নিচের দিক মাছের মতো লেজযুক্ত। সমুদ্রের উপরিভাগে ভেসে বেড়ানো এবং বসবাস করা এই জলপরীরা মাছের মতোই দীর্ঘসময় জল ছাড়া থাকলে নিস্তেজ হয়ে যায়।
মৎস্যকন্যার প্রথম বর্ণনা পাওয়া যায় অ্যাসিরিও সভ্যতায়। দেবী অ্যাটারগেটিস ভুলক্রমে তার প্রেমিককে হত্যা করেন। নিজের ভুল বুঝতে পেরে অভিশপ্ত হয়ে, তিনি সমুদ্রে আত্মহত্যা করতে গেলে সমুদ্রদেবতা পসাইডন রূপসী এই দেবীকে মৃত্যু না দিয়ে বরং অর্ধমানবী ও অর্ধমাছের শরীরের মৎস্যকন্যার জীবন দেন। ব্যাবিলনীয় উপকথায় এই কাহিনিটিই আছে দেবী ‘ইয়া’কে নিয়ে। গ্রিক সাহিত্যে অ্যাটারগেটিসের বর্ণনা আছে ‘আফ্রোদিতি’ নামে। এ ছাড়াও গ্রীক সাহিত্যে অ্যাটারগেটিস ‘দেবী ডার্কেটো’ নামে পরিচিত। তার অনুসারী সাইরেন নামের একদল সামুদ্রিক প্রাণীর পরিচয় পাওয়া যায়। যারা সমুদ্রের নাবিকদের আকৃষ্ট করে তাদের দ্বীপে নিয়ে যেতে জলকন্যা সেজে ভেসে বেড়ায় ও মোহনীয় সুরে গান গায়।
মৎসকন্যা বা সাইরেন মানুষের কাছে আদি কাল থেকে এক রহস্য।গ্রীক পুরাণে খুব সুন্দরভাবে লিপিবদ্ধ আছে মৎসকন্যা বা সাইরেনের কথা। মহাসমুদ্রের মৎসকন্যা বা সাইরেন(মারমেইড) ছিল গ্রিকপুরাণের মায়াবিনী গায়িকা। সুরের মায়াজাল সৃষ্টির মাধ্যমে তারা জাহাজের যাত্রীদের মৃত্যুর দিকে আকর্ষণ করতো। তাদের গানের গলা এতই চমৎকার ছিল যে সেই গান নাবিকদের কানে পৌঁছালে নাবিকরা সেই দ্বীপের দিকেই ধাবমান হতো।ফলে সেই জাহাজ চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে মৃত্যুবরণ করত সবাই। সাইরেন ছিল নদীদেবতা একিলেপাসের কন্যা। হোমারের ওডিসিতে বলা আছে সাইরেনদের ঊর্দ্ধাংশ মানবী এবং নিম্নাংশ পাখির মত দেখতে।সাইরেনিয়া নামে একটি দ্বীপে ছিল সাইরেনদের বাস। আর্গোনটরা (যারা সোনালী ভেড়ার চামড়া সংগ্রহ করতে অভিযান করতো) একবার সাইরেনদের দ্বীপ অতিক্রম করতে যাচ্ছিল। তাদের পরিণতির কথা ভেবে দেবী আফ্রোদিতি অর্ফিউসকে সাইরেনদের দ্বীপ অতিক্রমনের সময় তাঁর বীনায় মোহময় সুর সৃষ্টি করতে নির্দেশ দেন। অর্ফিউস ছিল সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব সুর স্রষ্টা।
দেবতাদের পর মরণশীলদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সুরের জাদুকর এই অর্ফিউস। সে এক বিশেষ ধরনের বাঁশি বাজাত, যেটার নাম ছিল লাইর। দেবতা হারমিসের তৈরি সেই বাঁশি পূর্ণতা পেয়েছে অর্ফিউসের কাছে। অর্ফিউস ছিল দেবতা অ্যাপোলোর পুত্র। অর্ফিউসের মা ছিল ক্যালিউপ। অর্ফিউসের বাস ছিল পিম্পলিয়ায়, যেখানে সে তার শৈশব মা এবং বোনদের সঙ্গে কাটিয়েছে। দেবতা অ্যাপোলো অর্ফিউসকে খুব ভালবাসতেন এবং তিনিই প্রথম অর্ফিউসকে লাইর বাজানো শেখান। জেসন ছিল আর্গোনট দলের নেতা। জেসনের দল যখন সাইরেনিয়া দ্বীপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন অর্ফিউস তার বাঁশি বাজানো শুরু করলো। তার সুর সাইরেনদের সুরকে ছাপিয়ে গেলো। নাবিকরা নিরাপদে দ্বীপ পার হতে পারলো।কিন্তু একজন আর্গোনট জাহাজের পাল ওড়ানোর কাজে ব্যস্ত থাকায় তার কানে অর্ফিউসের সুর প্রবেশে ব্যর্থ হয়। ফলে সে উন্মাদের মতো জাহাজ থেকে লাফিয়ে সাগরে পড়ে যায়। আফ্রোদিতি অবশ্য পরে তাকেও উদ্ধার করেন।
ট্রয়যুদ্ধ শেষে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথে মহাসমুদ্র দেবতা পোসিডনের ষড়যন্ত্রে দিকভ্রান্ত অডিসিউসও সাইরেনদের কবলে পড়েন। ফলে তিনি সাইরেনদের দ্বীপ অতিক্রম করার আগে প্রত্যেক নাবিকের কান মোম দিয়ে বন্ধ করে দেন এবং নিজেকে মাস্তুলের সঙ্গে বেঁধে রাখেন। ফলে সাইরেনরা প্রথমবারের মতো ব্যর্থ হয়। ব্যর্থতার লজ্জায় তারা সমুদ্রে ডুবে আত্মহত্যা করে। মৃত্যুর পর সাইরেনরা সমুদ্রশিলায় পরিণত হয়। এভাবেই গ্রীক পূরাণের একটি চমৎকার অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে।
আমেরিকা আবিষ্কারের সময়কালীন ক্রিস্টোফার কলম্বাসের লগবুকে ১৪৯৩ সালের ৯ই জানুয়ারি লেখা ঘটনায় মৎস্যকন্যার উল্লেখ পাওয়া যায়। কলম্বাস যখন ক্যারিবিয়ান দ্বীপ অতিক্রম করছেন; তখন না-কি তিনি নারী অবয়বের একটি মৎস্যকন্যাকে সমুদ্রের পারে বসে থাকতে দেখেন।তিনি সেটি লোককাহিনির মতো জাদুকর বিষয় হিসেবে বর্ণনা না করে, সাধারণ মানুষের মুখাবয়ব বিশিষ্ট একেকরকম মাছের উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে বিশ্লেষকরা মনে করেন কলম্বাস ম্যানাটিস বা এ জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণী দেখেছিলেন যাদের দূর থেকে দেখলে মানুষ বলে বিভ্রান্তি হয়। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে হেনরি হাডসনের নরওয়ে ভ্রমণের কাহিনিতেও মৎস্যকন্যা দর্শনের বর্ণনা পাওয়া যায়। ১৮৩০ সালে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ানের লেখা একটি একক মৎস্যকন্যার করুণ জীবনী যে মানুষের আত্মার জন্য সমুদ্রের কাছে নিজের জীবন বির্সজন দিয়েছিলো। এই গল্পের সুন্দর একটি সমাপ্তি দেয়া হয়েছে এবং এটিই প্রথম লেখনী যেখানে মৎস্যকন্যাদের মায়াবী ও নিদোর্ষ রূপে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছেন লেখক।