আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় তিনভাগের একভাগ জুড়ে আছে সাহারা মরুভূমি, আয়তন প্রায় ৩৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার। গ্রীষ্মে তাপমাত্রা পৌঁছায় ৫৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সাহারা পৃথিবীর উষ্ণতম ও শুষ্কতম স্থান হলেও, ১০ হাজার বছর আগে এটাই ছিল সবুজের স্বর্গ, জীবজগতের বসবাসের আদর্শ স্থান। ২০১০ সালে ভূবিজ্ঞানীরা সাহারা মরুভূমির তলায় এক অতিকায় হ্রদের খোঁজ পেয়েছিলেন। হ্রদটির আয়তন ছিল ৪৫ হাজার বর্গকিলোমিটার।
নেচার কমিউনিকেশনে প্রকাশিত একটি গবেষণা জানায় যে, উত্তর আফ্রিকার যে অঞ্চলে সাহারা মরুভূমি, তা আসলে ছিল সবুজ বনাঞ্চল। সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর কক্ষপথের পরিবর্তনের ফলে তার প্রকৃতি বদলে যায়। হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু বিজ্ঞানীদের গবেষণাটি সাহারার ‘সবুজায়নে’র বিষয়টি সামনে আনে। বিজনানীদের বক্তব্য, “সাহারা মরুভূমির সাইক্লিক রূপান্তর সাভানা এবং উডল্যান্ড ইকোসিস্টেমে গ্রহের সবথেকে উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত পরিবর্তনগুলির মধ্যে একটি। ঐতিহাসিকভাবে সাহারায় পর্যায়ক্রমে গাছপালা ছিল। সেখানে নদী, হ্রদও ছিল। জলজ প্রাণী ছিল। কিন্তু তা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। আনুমানিক ২১ হাজার বছরের ঋতুচক্রকে প্রভাবিত করে পৃথিবী তার অক্ষ বদল করে। এই পরিবর্তনগুলি বিভিন্ন ঋতুতে পৃথিবী দ্বারা প্রাপ্ত শক্তির পরিমাণ নির্ধারণ করে। ফলস্বরূপ আফ্রিকান বর্ষা ও এই বিশাল অঞ্চল জুড়ে গাছপালা বিস্তারকে নিয়ন্ত্রণ করে।
আজও সাহারার এই অংশে এমন কিছু সাইপ্রেস আর অলিভ গাছ দেখতে পাব, যেগুলির বয়েস কয়েক হাজার বছর। গাছগুলি এখনও তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। তাদের মূলগুলি মাটির অনেক নিচে নামতে বাধ্য হয়েছে জলের জন্য। জল পেয়ে বেঁচে গেলেও গাছগুলি হয়ে গেছে বন্ধ্যা। এই গাছগুলি শেষ হয়ে গেলে হয়তো আরও এক ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটবে। তবে বিশ্বের সেরা সেরা জীববিজ্ঞানীরা গাছগুলির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিয়েছেন ইতিমধ্যেই। এই গাছগুলি ছাড়াও আগে সাহারা মরুভুমির বুক জুড়ে একসময় ছিল ওক, সিডার,অ্যাশ, ওয়ালনাট, মাইটল আর লেবু গাছের ঘন ঝোপ জঙ্গল। জঙ্গলে ছিল বিভিন্ন ধরনের পশু ও পাখি। সবুজ সাহারার অনেকটা অংশ জুড়ে ছিল সাভানা তৃণভূমি। তৃণভুমি ও নদীর ধারে বাস করতো বিভিন্ন শ্রেণীর সরীসৃপ। সাহারা মরুভূমির বালির নিচে পাওয়া কুমিরের প্রচুর কঙ্কাল প্রমাণ করে, এই অঞ্চলের হারিয়ে যাওয়া অতিকায় হ্রদ ও নদীগুলিতে প্রাচীন কালে কুমির গিজগিজ করতো। আর, অতিকায় হ্রদের পাশে বাস করত মানুষ।
কেন শুকিয়ে গিয়েছিল সবুজ সাহারা! প্রায় দশ হাজার বছর আগে হঠাৎ সাহারা মরুভূমির আবহাওয়া পরিবর্তন হতে শুরু করে। কারণ, সূর্যের যে কক্ষপথে পৃথিবী ঘুরে বেড়ায়, তার আকারের পরিবর্তন। কোনও মহাজাগতিক সংঘর্ষে কক্ষপথের গঠনগত পরিবর্তন আসে। এর ফলে পৃথিবীর অক্ষ ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে হেলে যায়। পৃথিবীর অক্ষের সামান্য কৌণিক পরিবর্তন, পৃথিবীর আবহাওয়ার বিরাট পরিবর্তন ঘটায়। সেই আবহাওয়া পরিবর্তনের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে সবুজ সাহারার ওপর। মাত্র কয়েকশো বছরের মধ্যে শুকিয়ে যায় একটি অতিকায় হ্রদ, তিনটি বিরাট নদী ও প্রচুর শাখা নদী সমেত সবুজ সাহারা। বৃষ্টি বিদায় নেয় এই অঞ্চল থেকে, ফলে সাহারা সভ্যতার মানুষ বাধ্য হয় এলাকা ছাড়তে। তারা চলে যায় পূর্ব দিকের নীল নদের উপত্যকায়। ধীরে ধীরে মরুভূমির নিচে হারিয়ে যায় সহস্রাব্দ প্রাচীন সাহারা সভ্যতা। ওদিকে নীল নদের অববাহিকায় জেগে ওঠে মিশরীয় সভ্যতা।
সাহারা সভ্যতা যে ছিল তার প্রমাণ বিজ্ঞানীরা সাহারার বুকে খুঁজে পেয়েছেন ২০টি প্রস্তরযুগের কঙ্কাল। মনে করা হয় সেই জায়গাটি সাহারা সভ্যতার মানুষদের সমাধিক্ষেত্র ছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদরা সাহারা মরুর বালি সরিয়ে একটু একটু করে, এক অবাক করা পৃথিবীকে সামনে আনতে শুরু করেন। পুরো সাহারা মরুভূমি জুড়ে প্রায় ১০০ টি খনন ক্ষেত্র থেকে বিজ্ঞানীরা ভূতাত্ত্বিক নমুনা, পশুর হাড়, মানুষের ব্যবহৃত আদিম যন্ত্রপাতি, নাটকীয় ও রঙিন ছবি আঁকা পাথর আবিস্কার করেন। হেনরিখ বার্থ নামে এক জার্মান অভিযাত্রী এই অঞ্চলে পাঁচ বছরের ওপর কাটিয়ে হাজারের ওপর প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্র আবিস্কার করেন। গুহাচিত্রগুলিতে নাটকীয়ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে সাহারা সভ্যতার মানুষদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। দেখা যাচ্ছে পুরুষদের তীর ধনুক দিয়ে শিকার করতে,মহিলাদের চুল আঁচড়াতে বা কোনও ছবিতে বৃত্তাকারে নাচতে। ছবিগুলি থেকে জানা যাচ্ছে সাহারা সভ্যতার মানুষরা পশুপালন করত, দলবেঁধে নদীতে মাছ ধরত, গুহাচিত্রগুলিতে সাহারা সভ্যতার মানুষদের অর্ধ-গোলকাকৃতি বাড়িঘরও উঠে এসেছে। কিছু ছবিতে ঘরের সামনে বাসনপত্র দেখা গেছে। গুহাচিত্রগুলিতে হাতি, গন্ডার, সিংহ, জিরাফ, জলহস্তী, উটপাখি, বুনো মোষ এবং অ্যান্টিলোপ হরিণ দেখা গেছে। এর অর্থ ১০ হাজার বছর আগে এই সবুজ সাহারায় এরা বাস করত।