এই উপমহাদেশের ইতিহাসে রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহান সম্ভবত শেষ রাজপুত রাজা যিনি দিল্লি শাসন করেছিলেন। তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে তাঁর পরাজয়ের পরেই দিল্লিতে মুসলিম শাসন শুরু হয়। রাজপুত রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের বীরত্বের কথা যেমন ইতিহাস প্রসিদ্ধ তেমনি তাঁর প্রেমকাহিনী আজও লোককথার অংশ হয়ে মানুষের মুখে মুখে ফেরে। দ্বাদশ শতাব্দীর চৌহান বংশের রাজা পৃথ্বীরাজ চৌহানের সঙ্গে কনৌজের রাজা জয়চাঁদ এর কন্যা সংযুক্তার প্রেমকাহিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন প্রেমিক পৃথ্বীরাজ চৌহানের সভাকবি চান্দ বারদাই তাঁর ‘পৃথ্বীরাজ রাসো’ নামক কাব্যে। যেখানে বর্নিত হয়েছে অজানা-অদেখা মানব-মানবীর প্রেম, দূত মারফত দেখা, নায়িকার বাবার সঙ্গে নায়কের শত্রুতা, নায়িকার বাবা রাজা জয়চাঁদ-র কূটচাল এবং নায়কের পাল্টা কৌশল আর বীরোচিত ভূমিকায় রাজকন্যাকে আপন করে নেওয়া।

সংযুক্তার সখী চাকোরী বা মদনার মুখে পৃথ্বীরাজের নানান বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী শুনে রাজকন্যার মনে পৃথ্বীরাজকে দেখার এক প্রবল বাসনা জাগে। অন্যদিকে পৃথ্বীরাজও লোকমুখে সংযুক্তার রূপ-লাবণ্যের প্রশংসা শুনতে শুনতে তাঁর মনেও সংযুক্তাকে দেখার ইচ্ছে জেগে ওঠে। দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ হয় কোটেশ্বর মন্দিরে। পৃথ্বীরাজ ও সংযুক্তা দুজনেই ছদ্মবেশে একে অপরের সামনে এসেছিলেন। এরপর দুজনের সম্পর্ক আরও নিবিড় হয়। বিনিময় হয় একাধিক প্রেমপত্র। পৃথ্বীরাজের হয়ে ব্রজবুলি ভাষায় প্রেমপত্র লিখতেন খোদ চান্দ বারদাই। পায়রার মাধ্যমে সেই চিঠি পৌঁছে যেত কনৌজ রাজকন্যার হাতে। আবার সংযুক্তার প্রেমপত্র পৌঁছাত দিল্লির দরবারে।কিন্তু পৃথ্বীরাজ এবং সংযুক্তার গোপন প্রেমকাহিনীর ব্যাপারে রাজা জয়চাঁদ জানতে পেরে তড়িঘড়ি রাজকন্যার স্বয়ংবর সভার আয়োজন করেন। সেইসঙ্গে এক বিশাল রাজকীয় যজ্ঞেরও আয়োজন করেন। যজ্ঞের আগে জয়চাঁদ পৃথ্বীরাজ চৌহানের কাছে এক অপমানজনক চিঠি পাঠান। পৃথ্বীরাজ যোগ্য জবাব দেবার জন্য রাতারাতি পরিকল্পনা করেন। তিনি রাজকবি চন্দ্রবরদৈয়ের পদসেবক গনপথডাঙ্গির ছদ্মবেশে কনৌজের দরবারে পৌঁছান।

সেকালে রাজকবিদের বিশেষ সম্মান ছিল। শত্রুদেশের রাজাদের কাছেও বিদ্বান রাজকবিরা সমাদর পেতেন। চান্দ বারদাই, গনপথডাঙ্গি আর গুটি কয়েক চৌহানসেনা কনৌজের অতিথিশালায় স্থান পেলেন। কবিদের আলাপচারিতার সময় গনপথডাঙ্গি কনৌজের পণ্ডিতদের কিছু কাব্যরস সংক্রান্ত প্রশ্ন করেন কিন্তু কনৌজদেশীয় পণ্ডিতরা তার উত্তর দিতে না পারলে গনপথডাঙ্গি নিজেই সেই উত্তর দেন। এতে কনৌজদেশীয় রাজসভায় চান্দ বারদাইয়ের খ্যাতি আরও বাড়ে। রাতের অন্ধকারে পৃথ্বীরাজ যজ্ঞস্থলের কাছে পৌঁছে দেখলেন কয়েকশো সেনা যজ্ঞস্থল পাহারা দিচ্ছে। পৃথ্বীরাজ পাহারায় থাকা সমস্ত সেনাদের মেরে ফেলেন এবং যজ্ঞবেদীতে একটি চিঠি রেখে আসেন যাতে সহজেই বোঝা যায় ওই কাজ পৃথ্বীরাজ চৌহানের। পরের দিন ক্ষুব্দ জয়চাঁদ রাজকন্যার স্বয়ংবর সভার অয়োজন শুরু করলেন পৃথ্বীরাজকে কোনো আমন্ত্রণপত্র না পাঠিয়ে। বরং রাজসভার প্রবেশদ্বারে পৃথ্বীরাজের একটি মূর্তি বানিয়ে রাখলেন, উদ্দেশ্য পৃথ্বীরাজকে অপমান করা।চিন্তিত সংযুক্তা স্বয়ংবর সভার কথা জানিয়ে পৃথ্বীরাজকে চিঠি পাঠালে পৃথ্বীরাজ জানান যে তিনি স্বয়ংবরে উপস্থিত থাকবেন। স্বয়ংবর সভায় রাজকন্যা সংযুক্তা পৃথ্বীরাজের মূর্তির গলায় মালা দিলেন। আসলে পৃথ্বীরাজ ওই মুর্তির আড়ালেই লুকিয়ে ছিলেন। এই ঘটনায় উপস্থিত রাজারা হকচকিয়ে গেলেন। পৃথ্বীরাজ সংযুক্তাকে ঘোড়ায় চাপিয়ে স্বয়ংবর সভা ত্যাগ করলে কনৌজ সেনারা তাদের ধাওয়া করল। চাকোরী পৃথ্বীরাজকে কনৌজ থেকে বেরিয়ে যাবার গোপন পথ দেখিয়ে দেন। কিন্তু কিছু দূরেই চৌহান বাহিনী পৃথ্বীরাজের জন্য অপেক্ষা করছিল, চৌহান ও কনৌজ বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হলে জয়চাঁদের পরাজয় ঘটে। ধুমধাম করে সংযুক্তা এবং পৃথ্বীরাজের বিয়ে হয়।

প্রেমের এই গল্পটি এভাবেই শেষ হতে পারত। কিন্তু এ যে সাধারন কোনো প্রেমকাহিনী নয়! তাই প্রেমের গল্প আবার নাটকীয় এক মোড় নিল। এবার শ্বশুর জয়চাঁদ পরাজয় আর অপমানের বদলা নিতে হাত মেলালেন শত্রুপক্ষের সঙ্গে।এর আগে মুহাম্মদ ঘুরী তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আফগানিস্তানে ফিরে গিয়েছেন। প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে তার মনেও ছিল। সেই প্রতিশোধের আগুনে ঘি ঢাললেন জয়চাঁদ। তিনি ঘুরীকে দিল্লি দখলের আহ্বান জানালেন। সঙ্গে দিলেন সহায়তার আশ্বাস। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুহাম্মদ ঘুরী ফের ভারত আক্রমণ করেন। মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত আক্রমণের খবর শুনে অন্তঃপুর ছেড়ে পৃথ্বীরাজ যুদ্ধের ময়দানে নামেন। দেশপ্রেমিক রাজা পৃথ্বীরাজ আঞ্চলিক সব রাজ্যকে আহ্বান জানালেন তাকে সহায়তা করতে। কিন্তু জয়চাঁদ আগেই তাদের সহায়তা থেকে দূরে সরিয়ে ফেলেছেন। ফলে একা নিজের বাহিনী নিয়েই তরাইনের যুদ্ধের মাঠে নামতে হলো বীর যোদ্ধা পৃথ্বীরাজকে।কিন্তু এবার আর তিনি পারলেন না। অন্য রাজপুত রাজাদের অসহযোগীতায় তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে হল পৃথ্বীরাজকে। স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে রানী সংযুক্তাও অন্তঃপুরে আত্মাহুতি দেন। এভাবেই অসামান্য একটি প্রেমকাহিনী করুণ এক ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়।