দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা ইউরোপজুড়ে তখন বেজে উঠেছে পুরো মাত্রায়। যার আঁচ পড়েছে ফ্রান্সেও। স্বদেশকে শত্রুর হাত থেকে বাঁচানো এবং একই সঙ্গে শত্রুপক্ষের গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্য তখন ফরাসী সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা শাখার প্রধান জ্যাক আবতে এমন একজনকে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করলেন, যার কথা সেই সময় কেউ কল্পনাতেও আনতে পারেনি। তিনি তৎকালীন ফ্রান্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় মহিলা জোসেফিন বেকার। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া বেকারের শৈশব কেটেছে ছোট্ট খুপড়ি ঘরে। স্কুলে যাওয়া বেকারের মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যায়।আমেরিকায় কৃষ্ণবর্ণের জন্য অসংখ্যবার বৈষম্যের শিকার হন বেকার। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি একটি দলের হয়ে নৃত্যশিল্পী বা জোকারের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য দেশ ছেড়ে ফ্রান্সের প্যারিসে আবাস গাড়েন। নৃত্যশৈলীর জন্য কিছুদিনের মধ্যেই তিনি তৎকালীন আধুনিক সমাজে তারকাড় খ্যাতি অর্জন করেন। সঙ্গীত এবং চলচ্চিত্র জগতে নাম লেখানোর কিছুদিনের মধ্যেই বেকার ইউরোপে সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া তারকা হয়ে ওঠেন।

জোসেফিন বেকার-এর মতো একজন তারকার পক্ষে গুপ্তচর হওয়া সত্যি চ্যালেঞ্জের কারণ তিনি কখনো ছদ্মবেশে ভ্রমণ করতে পারতেন না। তবে, এই দুর্বলতাটিই শেষ পর্যন্ত তার গুপ্তরচরবৃত্তির জন্য সবচেয়ে বেশি সহায়ক হয়ে ওঠে।আসলে তাঁর খ্যাতিই ছিল তার গোপনীয়তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তিনি ভেবেওছিলেন নিজের সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্ব ও খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে সহজেই বিভিন্ন দূতাবাসের পার্টিগুলিতে গিয়ে সেখানকার কর্মকর্তাদের কাছ থেকে গোপন তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। আমেরিকায় যে স্বাধীনতা থেকে তিনি বারবার বঞ্চিত হয়েছেন, ফ্রান্সে সেই স্বাধীনতা পাওয়ার পর বেকার তার আশ্রয়দাতা দেশটির পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করতে রাজি হয়ে যান। ইউরোপের বিভিন্ন মঞ্চে পারফর্ম করার সময় ফ্যাসিবাদীদের কাছ থেকে অসংখ্যবার শোনা “গো ব্যাক আমেরিকা” শ্লোগান তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে। যদিও গুপ্তচর হিসেবে বেকার তার যাত্রা শুরু করেন ইতালি ও জাপান দূতাবাসের বিভিন্ন পার্টিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে। সেসব পার্টি থেকে তিনি অক্ষশক্তির দেশগুলির যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। ধরা পড়ার ভয়কে জয় করে তিনি যা কিছু শুনতেন তা হাতের তালু অথবা পোশাকের নিচে থাকা বাহুতে লিখে রাখতেন।

যখন জার্মান সেনাবাহিনী ফ্রান্সে ঢোকে তখনও বেকার প্যারিসে তার রাতের অনুষ্ঠানগুলি চালিয়ে যান। মুখোমুখি অংশ নেওয়া সেনাদের উজ্জীবিত করা এবং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া গৃহহীনদের সাহস যোগাতে তিনি রেডিওতে গান করেন।লাতিন আমেরিকা ট্যুরের নাম করে বেকার তার পোশাকের নিচে গোপন ফটোগ্রাফ বা ছবি লুকিয়ে এবং গানের খাতার মধ্যে অদৃশ্য কালিতে লেখা গোপন তথ্য নিয়ে যেতেন। সেখানে ছিল ফ্রান্সে জার্মান সেনাদের নানা অগ্রগতির তথ্য। সকলের চোখের সামনে দিয়েই বেকার স্পেন হয়ে নিরপেক্ষ পর্তুগালে পৌঁছান এবং ফরাসী গোয়েন্দা প্রধানও বেকার-এর ব্যক্তিগত সহকারীর ছদ্মবেশে সবার চোখকে ফাঁকি দেন।পর্তুগাল এবং স্পেনে বেকার বিভিন্ন দূতাবাসের পার্টিগুলিতে যোগ দিয়ে অক্ষশক্তির সেনাদের অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। গুপ্তচর বেকার শৌচাগারে লুকিয়ে তার সংগৃহীত গোপন তথ্য বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করতেন এবং নিজের অন্তর্বাসে সেফটি পিন দিয়ে আটকে রাখতেন।পরবর্তীতে তিনি লেখেন, ‘তারা বুঝতে পারলে আমার নেওয়া তথ্যগুলো তাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হত, কিন্তু জোসেফিন বেকার-এর দেহতল্লাশি করার সাহস কে দেখাবে? যখন তারা আমার কাছে কোনো কাগজ চাইত, তার মানে ছিল তারা অটোগ্রাফ চাইছে।’

অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসা চলার সময়ও বেকার গুপ্তচরবৃত্তি থেকে রেহাই নেন নি। কারণ, আমেরিকান কূটনীতিক এবং ফরাসী প্রতিরোধ বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে হাসপাতালে দেখতে যেতেন। ১৯৪২ সালের নভেম্বরে অপারেশন টর্চ-এর অংশ হিসেবে আমেরিকান সেনাদের মরক্কোতে প্রবেশ তিনি নিজের ব্যালকনি থেকে পর্যবেক্ষণ করেন। হাসপাতাল থেকে চূড়ান্তভাবে ছাড়া পাওয়ার পর বেকার আলজিয়ার্স থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত মিত্রশক্তির বিভিন্ন শিবিরে ঘুরে বেড়ান। দিনের বেলা তিনি নিজের জিপে করে উত্তর আফ্রিকার তপ্ত মরুভূমি পার হতেন এবং রাতে ল্যান্ড মাইন থেকে বাঁচতে তিনি সেই জিপের পাশেই মাটিতে বিছানা করে ঘুমাতেন।