প্রাচীন রোমের কিংবদন্তি অনুসারে, জ্যানাস হচ্ছেন নতুন কোনোকিছু শুরুর দেবতা, দরজা এবং তোরণের দেবতা। কোনো সফরের প্রথম পদক্ষেপটি তাঁর অনুমতি ছাড়া নেওয়া অনুচিত কাজ। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারি, তার নামানুসারেই রাখা হয়েছে বলে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের ধারণা। কখনো কখনো তাঁকে সময়ের দেবতা বলেও অভিহিত করা হয়। কোথাও কোথাও ফসল বোনা ও তোলার মোরসুমের শুরুতেও জ্যানাসের আরাধনা করা হতো। এমনকি জন্ম, বিয়ে, শেষকৃত্য এবং কিশোরদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলিতেও জ্যানাসের উদ্দেশে নৈবেদ্য উৎসর্গ করা হত।
রোমান সভ্যতার একদম শুরুতেই জ্যানাসের উপস্থিতি দেখা যায়। রোমুলাস যখন রোম প্রতিষ্ঠার পর স্যাবিন নারীদের অপহরণ করলেন, তখন এক উষ্ণ জলেরে ঝর্ণার বিস্ফোরণ ঘটান তিনি। এর ফলে, স্যাবিন রাজা টাটিয়াসের সৈন্যদের অধিকাংশই মারা যায় এবং বেঁচে যায় রোমানরা। দেবরাজ জুপিটার যখন তার বাবা স্যাটার্নকে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করেন, তখন তাঁকে আশ্রয় দেন জ্যানাস। সেই আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট হয়ে জ্যানাসকে অতীত এবং ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা উপহার দেন স্যাটার্ন। অন্য এক মতে, জ্যানাস এসেছিলেন থেসেলি থেকে। ল্যাটিয়ামে পা রাখার পর, সেখানে তাঁকে সাদরে বরণ করে নেন কেমিসে। এরপর তাঁদের বিয়ে হয়, তারা একাধিক সন্তানের জন্মও দেন। এই সন্তানদের একজন হচ্ছে টাইবার নদীর দেবতা- টাইবারনিয়াস। কেমিসে ছাড়াও, জানা ও জুতুর্না নামে আরো দুজন স্ত্রী ছিল জ্যানাসের। টাইবারনিয়াস ছাড়াও ফন্টাস নামে আরেক বিখ্যাত সন্তানের পিতা ছিলেন তিনি।
ল্যাটিয়ামের প্রথম রাজা হিসেবে জ্যানাস বহুদিন রাজ্য পরিচালনা করেন। তিনিই অর্থের প্রচলন করেন। সেই সঙ্গে আইন এবং ক্ষেতে কৃষিকাজ করার প্রচলনও তাঁর হাত ধরেই। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০ সালে এই দেবতার সম্মানে প্রতিষ্ঠা করা হয় বিখ্যাত মন্দির ‘ইয়ানাস জেমিনাস’ বা ‘জ্যানাস জেমিনাস’। এছাড়াও জ্যানিকুলাম ও অন্যান্য জায়গায় ছিল তাঁর মন্দির। দেবতা জ্যানাস এতটাই জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন যে, তার পুজো না করে কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান শুরুই হত না। এই ভাবে তিনি হয়ে যান লক্ষণের দেবতা। প্রসঙ্গত, রোমানরা লক্ষণ দেখে কাজ করতে এবং ভবিষ্যৎ আন্দাজ করতে খুব পছন্দ করতো। জ্যানাসকে অধিকাংশ সময় উপস্থাপন করা হয় দুই মস্তকধারী হিসেবে। দুটো মাথা পরস্পর বিপরীত দিকে মুখ করে। তাঁর অধিকাংশ মূর্তিতে রয়েছে এক গাল দাড়ি। ডান হাতে ধরে আছেন একটা ছড়ি, যেন সঠিক পথ দেখাতে পারেন ভ্রমণকারীদের। বাঁ হাতে আছে একটা চাবি, যা দিয়ে খুলে ফেলা যায় যে কোনো দরজা।
গ্রিক দেবতারা ভিন্ন ভিন্ন নামে রোমানদের প্রধান দেবতা হয়ে বসলেও, জ্যানাস তার নিজের অবস্থানে আসীন থাকেন। রোমান অনেক মুদ্রাতেও ব্যবহার করা হত এই দেবতার চেহারা। এখনো রোমের নানান জায়গায় তার প্রতিকৃতি চোখে পড়বে। এ থেকেই এই দেবতার প্রতাপ অনুমান করা যায়। চেহারার দিক থেকে দুমুখো দেবতা যেন এক শান্ত সমাহিত যোগীপুরুষ। পুরোনো স্থাপত্যের গায়ে কিংবা প্রাচীন রোমান মুদ্রায় জানুসের যেসব ছবি পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায় তাঁর একমাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, ঋজু টিকোলো নাক, অন্তর্ভেদী চোখ আর একগাল সযত্নলালিত দাড়ি। ঘাড়ের উপর দুদিকে বসানো দুই মুখ। কোনও কোনও স্থাপত্যে আবার এই দুই মুখের একটি মুখ যুবকের, অন্যটি বৃদ্ধের। বৃদ্ধের মাথায় মোষের মতো পাকানো শিং। পুরোনো পূর্ণাবয়ব মূর্তিগুলিতে দেখা যায় দেবতা জ্যানাস তাঁর ডানহাতে ধরে আছেন একটা বেশ বড় চাবি, বা চাবির-গোছা৷
স্বর্গের দরজা ও ধনসম্পত্তির রক্ষক যিনি, তাঁর হাতে চাবি থাকবে, এ আর আশ্চর্য কী! কিন্তু প্রাচীন রোমে ‘চাবি’ একটা রূপক, যা দিয়ে অনেকসময় ভ্রাম্যমাণ বণিকদেরও বোঝানো হত। নিরাপদ বন্দর বা পণ্যের সন্ধানে দূরদেশ থেকে আসা বণিকেরা সেসময় চাবির প্রতীক ব্যবহার করতেন। সেদিক দিয়ে ভাবতে গেলে রোমের সঙ্গে অন্যান্য দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক লেনদেনের দেবতাও ছিলেন সম্ভবত এই দু-মুখো আদিদেব জ্যানাস। প্রায় ৩৩ কোটি দেবদেবীর পুজো করতেন প্রাচীন রোমের মানুষ। সমুদ্রের দেবতা পসেডিওন, প্রেম আর সৌন্দর্যের দেবী ভেনাস, সূর্যের দেবতা অ্যাপেলো তো ছিলেনই, এছাড়াও ছিলেন মার্কারি, মার্স, জুনো, নেপচুনের মতো সুপরিচিত দেবতারা। এঁদের তুলনায় জানুস কিছুটা কম পরিচিত হলেও গুরুত্বের দিক থেকে তাঁর দাবি কোনো অংশে কম তো নয়ই, বরং বেশ উপরে। রোমান শাস্ত্র অনুসারে ছিলেন পথ, দরজা, এবং দিশানির্ণয়কারী দেবতা। দুদিকে দুটো মুখ থাকার জন্যই সম্ভবত তিনি হয়ে উঠেছিলেন সমস্ত পরস্পরবিরোধী শক্তির দেবতা। বাস্তব আর অবাস্তব, সত্যি আর কল্পনার ঠিক মাঝখানে যেন দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।
জীবন-মৃত্যু, যৌবন-বার্ধক্য, শুরু-শেষ, যুদ্ধ-শান্তি, বর্বরতা-সভ্যতা, এই সমস্ত কিছুই ছিল জানুসের অধিকারে। মরজীবন থেকে অমরলোকে যাওয়ার পথে দিশা দেখাতেন তিনিই। শুধু তাই নয়, প্রাচীন রোমের লোকজন বিশ্বাস করতেন যেকোনও শুভকাজের আগে জানুসের পুজো করতে হয়। যেকোনও শুভকাজ, তা বিয়ে হোক, বা শিশুর জন্ম, চাষের বীজ রোপন, ঋতুপরিবর্তন বা নতুন বছরের শুরু – যেকোনও কিছুর আগেই তুষ্ট করতে হত দুমুখো দেবতা জানুসকে। এই জন্যেই প্রাচীন রোমের যেকোনও ধর্ম অনুষ্ঠানে সবার আগে জানুসের আহ্বান করা হত। দেবতাদের মধ্যে প্রথম পুজো পাওয়ার অধিকারীও ছিলেন তিনি। অন্যান্য দেবতার পুজো করার আগে জ্যানাসের নামে নৈবেদ্য দিতে হত। প্রথম বলিও উৎসর্গ করা হত তাঁকে।জ্যানাস মাস, তাই তাঁর নাম অনুসারেই সেই মাসের নাম হয় জানুয়ারি।