পাকিস্তানের ৭৪ বছরের ইতিহাসে ১৮ জন প্রধানমন্ত্রী যা পারেননি, ইমরান খানও যেসেই ট্র্যাডিশন ভাঙতে পারবেন না, সে কথা আগেই বলেছিলাম।একমাত্র শওকত আজিজ ছাড়া পূর্বসূরিদের মতো পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই কিংখানকে যে প্রধানমন্ত্রীর কুর্শি ছাড়তে হবে সে কথা প্রায় সবাই বলেছিলেন। প্রসঙ্গত, পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের ম্যাচে অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার বদনাম আছে। সেদিক থেকে ইমরানের ইমেজ ছিল স্বচ্ছ। কিন্তু রাজনৈতিক মাঠ যে অনেক বেশি কর্দমাক্ত। ইমরানও পারেননি তাঁর আগের জীবনের পরিষ্কার ইমেজটি ধরে রাখতে। পাকিস্তানের বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক ক্রিকেটার ইমরান সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু দ্রুত দুই ইমরানের বিস্তর ফারাক ঘটে যায়। ক্রিকেট জীবনে ইমরান মোটামুটি সর্বস্বীকৃত সজ্জন পরিচয়ে থাকলেও রাজনীতিক; বিশেষত প্রধানমন্ত্রী ইমরান মোটেও সর্বজন শ্রদ্ধেয় হতে পারেন নি।
পাক সেনাবাহিনীর সৌজন্যে ২০১৮ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন- এমনটাই সে দেশে প্রচলিত। যদিও পাকিস্তানকে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট জয়ে নেতৃত্ব দেওয়া ইমরান প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে দেশের ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই আর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।কিন্তু বাস্তবতা হল অর্থনৈতিক সংকটের কারণেই বিপাকে পড়ে যায় ইমরান ও তাঁর সরকার। ধীরে ধীরে গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের (#ISI ) প্রধান নিয়োগ নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়ান তিনি। এমনকি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর ইমরানের মস্কো সফর বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বিশেষ করে আমেরিকা সুনজরে দেখেনি। ইতিমধ্যে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন জোটের বড় অংশ এমকিউএম ইমরানকে ছেড়ে বিরোধী জোটে যোগ দিলে ইমরানের সরকার সংখ্যা গরিষ্ঠের সমর্থন হারায়।
ইমরান খান এই ঘটনার কয়েকদিন আগে থেকেই বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ‘বিদেশি রাষ্ট্রের’ সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগ করছিলেন। কারণ হিসাবে ইমরানের ব্যাখ্যা ছিল, যেহেতু তিনি রাশিয়া এবং এবং চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অস্বীকার করেছেন তাই তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। তিনি এর পিছনে আমেরিকার হাত আছে বলেও দাবি করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন হারানোর পরই ইমরান খান পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ বিরোধী নেতারা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সংবিধানের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তুলে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন। সুপ্রিম কোর্টের আদেশের পর শনিবার সকালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসে। কিন্তু সেই অধিবেশন তিন চার দফা মুলতুবি হবার পর ভোটাভুটি গড়ায় মধ্যরাতের পর। জাতীয় পরিষদের ৩৪২জন সদস্যের মধ্যে ১৭৪ জন সদস্য ইমরানের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে ভোট দেন।বহু নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ খোয়ান ইমরান।কেবলমাত্র গদিচ্যুতই নয়, মধ্যরাতেই কপ্টার চেপে প্রধানমন্ত্রীর আবাসনও ছাড়তে হয় ইমরানকে। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম একজন প্রধানমন্ত্রীকে অনাস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে গদিচ্যুত হতে হল।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দেওয়ার আগে তিনটি শর্ত রাখেন ইমরান খান ( #ImranKhan )। পদ ছাড়ার পর তাঁকে গ্রেপ্তার যেন না করা হয়।তাঁর অপছন্দের ব্যাক্তি শাহবাজ শরিফের জায়গায় যেন অন্য কাউকে প্রধানমন্ত্রী করতে হবে। তৃতীয় শর্ত হিসেবে তিনি বলেছেন যে পদ ছাড়ার পরে তার বিরুদ্ধে NAB ধারায় কোনও রকম মামলা দায়ের যাতে না করা হয়। তার আগে ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ডেপুটি স্পিকার খারিজ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ডেপুটি স্পিকারের রুলিংকে অসাংবিধানিক আখ্যা দেয়। ইমরান খানের সুপারিশ মেনে প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভিন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে দিয়ে নির্বাচন ঘোষণা করেছিলেন।সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশকেও অসাংবিধানিক রায় দিয়ে শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন ডাকার নির্দেশ দেয়। সুপ্রিম কোর্ট এও জানায়,অনাস্থা ভোটপর্ব নিয়ে বেশি দেরি করা চলবে না আর অনাস্থা ভোটের ফলাফল ঘোষণা না করে অধিবেশন শেষ করা যাবে না।
ক্রিকেটার থাকাকালীন ইমরান খান পাকিস্তানকে অনেক হারা ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে তিনি বিরোধীদের আনা অনাস্থার মোকাবিলা করতে যে কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন, তা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে সম্পূর্ণ ভাবে ভেস্তে গেল।পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে তাই আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই ইমরানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ধাক্কা বলেই মনে করছেন। কারণ ইমরান খানের রাজনৈতিক জীবনে সুপ্রিম কোর্টের এই রায় একটি বিরাট বড় ধাক্কা হয়ে থেকে যাবে।ইমরান খান বলেছিলেন তিনি ইনিংশের শেষ বল পর্যন্ত লড়বেন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের ওই রায় ছিল পাঁচ বিচারপতির মতৈক্যের ভিত্তিতে। যা নিয়ে তাদের কারও কোনো মতবিরোধ ছিল না। বিচারপতিরা প্রত্যেকেই জানান, ডেপুটি স্পিকারের রুলিং সংবিধান ও আইনসম্মত নয়। ফলে এর কোনো আইনি বৈধতা নেই। তাই ইমরান খান সংবিধান অনুসারে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেয়ার সুপারিশ করতে পারেন না। তার সুপারিশের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্টের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্তও অসাংবিধানিক।
তবে পাকিস্তানে নাটকের খামতি নেই।ইমরান সরকারের পতনের পর পরবর্তী পাক প্রধানমন্ত্রী পদে শাহবাজ শরিফকে নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা। লাহোর হাইকোর্ট বেআইনি লেনদেন সংক্রান্ত মামলায় সমন পাঠিয়েছে শাহবাজ শরিফ ও তাঁর ছেলেকে।এদিকে, আগামীকাল দুপুর দুটোয় পাক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন।শাহবাজ শরিফ ও তাঁর ছেলেকে লাহোর হাইকোর্টের সমন পাঠানো স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দেয় যে বিচার ব্যবস্থাও পাকিস্তানের রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছে। এদিকে পিটিআই-এর তরফে প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হিসেব বেছে নেওয়া হয়েছে প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশিকে।
4 Comments
ক্ষমতা হারানো ইমরান খান কি এবার রাজনীতি থেকে বিদায় নেবেন? মাত্র চার বছর আগে যিনি দুর্নীতিমুক্ত পাকিস্তান গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি কি নিজেকে রাজনীতিতে স্বচ্ছ রাখতে পেরেছেন?
পাকিস্তানের ২৩ তম প্রধানমন্ত্রী হবেন মুসলিম লিগের অন্যতম নেতা শেহবাজ শরীফ। তিনি নওয়াজ শরিফের ছোটভাই, ইমরানের প্রধানমন্ত্রীত্বে তিনি ছিলেন জাতীয় পরিষদের
প্রধান বিরোধী নেতা। শাহ মোহম্মদ কোরেশি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন না। ফলে শেহবাজ শরীফ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রধানমন্ত্রি হচ্ছেন।
২০১৭ সালে পানামা পেপারস বিতর্কে তারও নাম জড়িত ছিল। তার আগে ১৯৯৯ সালে সেনা অভ্যুত্থানের পর তাঁকে আটক করা হয়। এর পরই তিনি আরবে পালিয়ে যান। ২০০৭ সালে পাকিস্তানে ফেরেন, ২০১৭ সালে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে নাম লেখানো মিঞা মহম্মদ শাহবাজ শরিফ এবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী।
পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রীকে সবথেকে প্রথমে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। নতুন প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন কাশ্মীর সমস্যার সমাধান না
হওয়া পর্যন্ত দু’দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না।