কোটা সংস্কার থেকে শুরু হয়ে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশত্যাগ বুঝিয়ে দিয়েছে ছাত্রসমাজ তাদের আন্দোলনকে এক পর্যায়ে সফল করতে পেরেছে। কয়েকশো মানুষের প্রাণের বিনিময়ে এসেছে এই সফলতা। দাউদাউ আগুন জ্বলেছে, পুড়ে ছাই হয়েছে ঘরবাড়ী, মানুষে মানুষে হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, লাঠালাঠি, লুটপাট তবেই পতন হয়েছে কর্তৃত্ববাদী সরকারের। বাংলাদেশে এখন নতুন অন্তর্বর্তী সরকার। এখনও আগুন নেভেনি পুরোপুরি, অশান্তি বিরাজ করছে বহু জায়গায়, প্রকাশ্যে অথবা আড়ালে ক্ষোভ-ঘৃ্না-আক্রোশ-বিদ্বেষ মাথা চারা দিয়ে উঠছে থেকে থেকেই। সামনের দিনগুলি যে বাংলাদেশের জন্য খুব একটা সহজ বা সুখের সেকথা বিশ্লেষকদের মতামতে স্পষ্ট হচ্ছেনা, বরং তাঁরা বলছেন, নতুন অন্তর্বর্তী সরকারকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।
কয়েকদিন আগেই হাসিনা সরকারের পতন ও তাঁর দেশত্যাগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী একটি সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকা পালন করে। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। আপাতত বলা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালিত হবে বেসামরিক নেতৃত্বে। তাহলে কি এই সরকারের ওপর সেনাবাহিনীর প্রভাব থাকবে না? উত্তরে স্পষ্ট করে এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়। কেউ কেউ বলছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে না থাকলেও এই সরকারে ওপর সামরিক বাহিনীর একটা প্রভাব থাকবেই। তাদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘ হলে সরকারে নিজেদের কর্তৃত্ব দৃঢ় করার সুযোগ পাবে সেনাবাহিনী। তবে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, সেনাবাহিনী সরকারে সক্রিয় ভূমিকা ও রাজনীতির কেন্দ্রে থাকার বিষয়ে অতটা আগ্রহী নয়, যেমনটা কয়েক দশক আগে দেখা গিয়েছিল।
হাসিনা ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে চলা আন্দোলনে যত মানুষের প্রাণ গিয়েছে, হামলা হয়েছে, হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পরও শুরু হয়েছে প্রতিশোধমূলক হামলা। তার থেকে রেহাই মেলেনি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীরাও। বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠী ও কূটনীতিকেরা এইসব হামলার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা, সাধারণ মানুষের মন থেকে আতঙ্ক দূর করা, আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার করা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম কাজ হবে জনমানসে নিরাপত্তা এবং শান্তি ফিরিয়ে আনা পাশাপাশি বাক্স্বাধীনতা ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের পথ তৈরি করা। একই সঙ্গে নতুন করে যাতে আর কোনো হিংসার ঘটনা না ঘটে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়াটাই হবে নতুন সরকারের সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ।
নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ অর্থনীতি। ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশের গড় বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ শতাংশের বেশি। ২০২১ সালে মাথাপিছু আয়ে ভারতকেও ছাড়িয়ে যায় বাংলাদেশ; কিন্তু এরপর সে দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সবাই সমানভাবে পায়নি। সাম্প্রতিক অস্থিরতা এবং হিংসা বাংলাদেশের পোশাক থেকে শুরু করে অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রকে বিরাট ধাক্কা দিয়েছে। অশান্তি ও হিংসার সময় পোশাক ও অন্যান্য কারখানাগুলো বন্ধ হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পোশাক কারখানা আছে। সে দেশের বার্ষিক সাড়ে ৫ হাজার কোটি ডলারের রপ্তানির মধ্যে প্রায় ৮৫ শতাংশই আসে পোশাক রপ্তানি থেকে। বিশ্বের শীর্ষ খুচরা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলির দ্বিতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কোনো নির্বাচন হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরানোর জন্য দীর্ঘ মেয়াদে কাজ শুরু করতে হবে। গত দেড় দশকে দেশটির গণতান্ত্রিক পরিস্থিতির যে ব্যাপক অবনতি হয়েছে। সেই পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন হবে, তা অনেকটাই নির্ভর করছে সাম্প্রতিক হিংসা ও বিশৃঙ্খলা নিরিসনে ব্যর্থ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ওপর। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে কাজ শুরু করে নতুন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করবে যে ব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষ আস্থা রাখতে পারে একই সঙ্গে সরকার জনগণকে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে।
অন্তর্বর্তী সরকারকে মনে রাখতে হবে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা বিগত ১৬ বছরে একটি নির্বাচনও ঠিকভাবে করেননি। ২০১৪ সালের নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন, ২০১৮ সালে দিনের ভোট হয়েছিল রাতে, ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে হয় প্রতারণা। এককথায় নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংসের সঙ্গেই কেড়ে নেওয়া হয় মানুষের মৌলিক অধিকার। বিরোধী দলগুলিকে নির্মূল করতেই হত্যা, গুম, হামলা ও মামলার পথ নেওয়া হয়েছিল। দুর্নীতি হয়ে উঠেছিল একটি গোটা জাতির নীতি। দেশের যাবতীয় সম্পদকে পৈতৃক মনে করে ক্ষমতাসীন দল বেপরোয়া লুটপাট চালিয়েছে। ব্যাংকগুলিকে ফতুর করে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভ আতঙ্কজনক অবস্থায়, আমদানি-রফতানি পরিস্থিতি সঙ্কটাপন্ন, দ্রব্যমূল্য মানুষের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে, আমলাতন্ত্র দলতন্ত্রে পরিণত, দেশের বুদ্ধিজীবীরা নগ্নভাবে তাদের মাথা বিক্রির প্রতিযোগিতা করেন, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী সর্বত্রই সুবিধাবাদ আর নিকৃষ্ট ক্ষমতার মোহে ক্রিমি-কীটে পর্যবসিত। শোচনীয় এই অবস্থায় নাগরিক সাধারণ বিশেষত ছাত্র-যুবসমাজ ক্ষোভ দুঃখ ও ক্রোধ আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।