৯ অগস্ট সকালে আরজি কর হাসপাতালের সেমিনার রুম থেকে অর্ধনগ্ন অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে এক মহিলা চিকিৎসকের দেহ। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে একাধিক আঘাতের কথা লেখা আছে। বাদ দেওয়া হয়নি ধর্ষণের সম্ভাবনাও। তরুণী চিকিৎসকের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে উত্তপ্ত কলকাতা এবং একাধিক জেলা। কর্তব্যরত অবস্থায় হাসপাতালেই যৌন নির্যাতনের শিকার হন ওই নারী চিকিৎসক, যা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সামাজিক বিপর্যয়ে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন না কেউ, সংবেদনশীল যে কোনো মানুষ এমন ঘৃণ্য ঘটনায় ধিক্কার জানান, প্রতিবাদের আওয়াজ তোলেন পাশাপাশি তার ভিতরে এক অনিশ্চয়তা্ বোধ তৈরি হয়, তিনি নিরাপত্তাহীনতাও বোধ করেন। আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনাতেও অনেকের মধ্যে এমনটা হয়েছে। তাঁদের প্রতিবাদ সমাজমাধ্যমে আছড়ে পড়েছে। ‘বিচার চাই’ কথাটি জ্বলজ্বল করছে প্রত্যেকের সমাজমাধ্যমে।
ওই ঘটনার পর শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে আরজি করে জরুরি পরিষেবা ছাড়া অন্য সমস্ত বিভাগে কর্মবিরতির ডাক দিয়ে আন্দোলনে নেমে পড়েন জুনিয়র ডাক্তারেরা। শনিবার জেলার বিভিন্ন হাসপাতালগুলিতেও একই ছবিই দেখা যায়। দোষীর শাস্তির দাবিতে কোথাও বিক্ষোভ মিছিল করেন চিকিৎসকেরা, কোথাও আবার কর্মবিরতি। দোষীর কঠোর শাস্তির দাবির পাশাপাশি বিক্ষোভকারী চিকিৎসকদের প্রশ্ন, কলকাতা শহরের সরকারি হাসপাতালে যদি এ রকম ঘটতে পারে, তা হলে জেলার হাসপাতালে চিকিৎসকদের, বিশেষত মেয়েদের নিরাপত্তা কোথায়? খুবই সঙ্গত প্রশ্ন এবং যুক্তিযুক্ত তাদের প্রতিবাদ আন্দোলন। কিন্তু আপৎকালীন পরিষেবা চালু রেখে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের জেরে জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে বহির্বিভাগে বা আউটডোরে এর বিরাট প্রভাব পড়ে কারণ ব্যাহত হয় স্বাস্থ্য পরিষেবা। হাসপাতালগুলির আউটডোরে লম্বা লাইন পড়ে সকাল থেকেই। বিপাকে পড়েন দূরদূরান্ত থেকে আসা রোগীরা। অভিযোগ, কোথাও কোথাও হাসপাতালে ইন্ডোর পরিষেবাও ব্যাহত হয়। কারণ, মূলত যাঁরা আন্দোলন করছেন, সেই জুনিয়র ডাক্তারদের কাঁধে ভর করেই চলে হাসপাতালের বড় অংশের পরিষেবা।
মহিলা চিকিৎসক ‘খুনের’ ঘটনার পর ভুরিভুরি অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। হাসপাতালে টানা ডিউটির মাঝে নেই রেস্টরুম।এমনকি জামাকাপড় বদলানোর জায়গা নেই! এখানেই শেষ নয়, মেল ওয়ার্ডে ভিজিট করতে হয় কোনো নিরাপত্তা ছাড়াই। এটা কী করে হয় যে, একটা হাসপাতালে কোনও নিরাপত্তা নেই। নিরাপত্তা যে নেই সেকথা বলাই বাহুল্য, তা না হলে রাতের বেলায় একজন মহিলা চিকিৎসক ধর্ষিত হয়ে খুন হন কীভাবে? পরের দিন সকালে তাঁর দেহ উদ্ধার হয়। এমবিবিএস পাস করার করার পর আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতালে চেষ্ট মেডিসিন নিয়ে স্নাতকোত্তরের দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছিলেন বছর একত্রিশের ওই মহিলা চিকিৎসক। হাসপাতাল থেকে পাওয়া খবর, বৃহস্পতিবার রাতে ‘On Call’-এ ছিলেন মহিলা চিকিৎসক। রাত দুটো নাগাদ তাঁর ডিউটি শেষ হয়। তারপর জুনিয়রদের সঙ্গে ডিনার সারেন। এরপর জরুরি বিভাগের চারতলায় ‘চেষ্ট ডিপার্টমেন্টে’র সেমিনার হলে বিশ্রামের জন্য ঢুকে যান। শুক্রবার সকালে সেই সেমিনার হল থেকেই উদ্ধার হয় তাঁর মৃতদেহ।
আরজি কর হাসপাতাল সূত্রের খবর, ধৃত সঞ্জয় রায়ের আর জি কর হাসপাতালে অবাধ যাতায়াত ছিল। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার ইয়ার ফোনের সূত্র ধরে গ্রেফতার করা হয় তাকে। আরও জানা যায়, ‘সিসিটিভি-তে দেখা গিয়েছে গলায় ইয়ার ফোন ঝুলিয়ে সেমিনার রুমে ঢুকছে সঞ্জয়, ৩০ মিনিট পর সেমিনার রুম থেকে ইয়ার ফোন ছাড়াই বেরোয় সঞ্জয়। অনলাইনে আনানো খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিতে যান চিকিৎসক। সিসিটিভি-তে ৪ জনের গতিবিধি লক্ষ্য করা যায়। সবাইকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় সঞ্জয়ের কথায় অসঙ্গতি ধরা পড়ে। এদিনের ঘটনায় যে প্রশ্নটি জোরালো ভাবে উঠে এসেছে সেটি হল হাসপাতালে অনধিকার প্রবেশের বিষয়টি। পুলিস প্রশাসন এবং হাসপাতালের সিকিউরিটি ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বাইরের লোক কী করে হাসপাতালের ভিতরে ঢোকে?
নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন আগেও উঠেছিল। সেই প্রশ্ন আরও বড় করে দেখা দিলো কারণ, চিকিৎসকের মৃত্যু ঘিরে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ উঠেছে। কেন একাধিকবার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেও কোনও নিরাপত্তা রক্ষী মোতায়েন করা গেল না গত তিন বছর ধরে, কেনই বা সিসিটিভি লাগানো হচ্ছে না এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায়, সে প্রশ্নে সরব হয়েছেন জুনিয়র ডাক্তারদের একটা বড় অংশ। মাস তিনেক আগেও এক তরুণী চিকিৎসক যখন রাতে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন অন-কল রুমে, তখন ভোররাতের দিকে তিন মদ্যপ ওই ঘরে ঢুকে পড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন। তবে শুধু সেমিনার রুম কিংবা অন-কল ডিউটি রুমেই নয়, আরজি করের বিভিন্ন ভবনেরই বিস্তীর্ণ এলাকায় না আছে নিরাপত্তা রক্ষী, না রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। কিন্তু এভাবেই চলছে একটি সরকারি হাসপাতাল।