বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সিপিআই(এম)’র সদস্য পদ লাভ করেন ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৮ সালে তিনি গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের সম্পাদক নির্বাচিত হন। সিপিআই(এম)’র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন ১৯৭১ সালে। রাজ্য সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য হন ১৯৮১ সালে এবং ১৯৮৫ সালে তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্যও হন ২০০০ সালে। স্বাস্থ্যের কারণে তিনি ২০১৫ সালে সিপিআই(এম)’র পার্টি কংগ্রেসে পলিট ব্যুরোর সদস্যপদ থেকে অব্যহতি নেন। তবে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি সাম্মানিক সদস্য ছিলেন। কিন্তু ২০১৮ সালে তিনি পার্টির রাজ্য সম্পাদকমন্ডলী থেকেও অব্যাহতি নিয়ে রাজ্য কমিটিতে সাম্মানিক সদস্য হয়েছিলেন।
১৯৭৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তিনি কাশীপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিধায়ক নির্বাচিত হন। ওই বছরই ৩৩ বছর বয়সে তিনি রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের মন্ত্রী হন। ১৯৮৭ সালে তৃতীয় বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভায় তিনি পৌর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরেরও দায়িত্ব পান। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে তিনি যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়ে চতুর্থ ও পঞ্চম বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। ১৯৯৬ সালে তিনি রাজ্যের স্বরাষ্ট্র (পুলিশ) দপ্তরের দায়িত্বও পান। স্বাস্থ্যের কারণে জ্যোতি বসু যখন মন্ত্রিসভায় নিজের ভার লাঘব করতে চাইছিলেন তখন ২০০০ সালের জুলাই মাসে উপমুখ্যমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
২০০০ সালের শেষের দিকেই জ্যোতি বসু মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে সরকারের নেতৃত্ব তুলে দেন। ওই বছর ৬ নভেম্বর মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এরপর ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তিনি ফের নির্বাচিত হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেন। ২০০৬ সালেও এই কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হন। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের পরাজয় হওয়া পর্যন্ত তিনিই মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সাড়ে দশ বছর এই দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন।
সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অন্তরের যোগ ছিল। বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক ছিলেন। নিজে অনুবাদ করেছেন মায়াকোভস্কির কবিতা, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, কাফকার রচনা। জীবনানন্দ দাশ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর তাঁর লেখা বই বিশেষজ্ঞদের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত। নিজে কবিতা লিখেছেন, নাটক রচনা করেছেন। আবার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, বামপন্থী রাজনৈতিক বিষয়ে বহু প্রবন্ধ এবং পুস্তিকা লিখেছেন। বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালের অভিজ্ঞতা নিয়েও বই রয়েছে। চলচ্চিত্র সম্পর্কে শুধু ওয়াকিবহাল ছিলেনই না, মাধ্যম হিসাবে সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশে তার ব্যবহারে তিনি উৎসুক ছিলেন। কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবকে আন্তর্জাতিক মানের করে তুলেছিলেন তিনি। জেলায় জেলায় রবীন্দ্রভবন গড়ে তোলা ও কলকাতায় আন্তর্জাতিক মানের প্রেক্ষাগৃহ নন্দন গড়ে তোলায় তাঁর বিশেষ অবদান ছিল।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিভিন্ন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ফ্রান্স সফর করেছেন। কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত জীবন ছিল অনাড়ম্বর, কমিউনিস্ট গুণাবলীতে পূর্ণ। রাজনৈতিক ভাবে ভিন্নমতের মানুষও তাঁকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হওয়ার আগে দমদম আদর্শ বিদ্যামন্দিরে বছর দুয়েক শিক্ষকতা করেছিলেন। সেই সময়ে বাংলায় খাদ্য আন্দোলন, ভিয়েতনামের প্রতি সংহতি আন্দোলনসহ বহু গণআন্দোলনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ব্যক্তিগত সততার নিরিখে এক বিরল রাজনীতিক। ধুতি-পাঞ্জাবি এবং কোলাপুরি চপ্পলে আপাদমস্তক বাঙালি ভদ্রলোক। রাজ্যকে শিল্পায়নের সরণিতে দ্রুত এনে ফেলতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব। কিন্তু সিঙ্গুরে এবং নন্দীগ্রামে ‘জোর করে’ কৃষিজমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক জটিলতা চরমে উঠেছিল। সেই সময় তাঁর সরকারের স্লোগান ছিল, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব থেকেই বিতর্ক তাড়া করতে শুরু করেছিল বুদ্ধদেবকে। কোথাও কোথাও প্রশাসনিক রাশ আলগা হওয়াও চোখে পড়ছিল। ২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে এবং ২০০৮-এর পঞ্চায়েত ভোটে ধাক্কা খায় বামফ্রন্ট। ধাক্কা বিরাট আকার নেয় ২০০৯ লোকসভা ভোটে। রাজ্যের পরিস্থিতির উপর রাশ হারাতে শুরু করে বুদ্ধদেবের প্রশাসন। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্য রাজনীতিতে বড় পটপরিবর্তন ঘটে। বুদ্ধদেবের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টকে হারিয়ে দেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। অবসান হয় দীর্ঘ সাড়ে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের। রাজভবনে নতুন মুখ্যমন্ত্রী মমতার শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন বুদ্ধদেব। সুভদ্র রাজনীতিক সেই আমন্ত্রণ ফেরাননি।