বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেবে বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনী প্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। তার আগে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার সিদ্ধান্ত হয়।মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে এই সরকারের উপদেষ্টা ১৫ জন হবেন বলেও জানা গিয়েছে। প্যারিস থেকে ইউনূস বাংলাদেশে আসবেন বৃহস্পতিবার দুপুরে। প্রবল গণআন্দোলনের জেরে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এবং রাজনৈতিক দলের নেতার প্রস্তাব অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
যদিও রাজনৈতিক নেতারা ও কোটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলছেন, তবু একটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধানে এ ধরনের কোনও বিধান কী রয়েছে? নেই। সংবিধানে কেবল নির্বাচিত সরকারের কথাই বলা আছে। নির্বাচিত সরকারের বিকল্প হিসেবে আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান থাকলেও উচ্চ আদালত তাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধানটি বাতিল হয়। ফলে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তিকালীন সরকারের বিধানটি না থাকায় এটি কীভাবে গঠিত হবে, তা নিয়ে নতুন প্রশ্ন জেগেছে। অবশ্য বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দিনের অস্থায়ী সরকারের প্রধান হওয়ার বিষয়টিকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, রাষ্ট্রের ক্লান্তিকালে এ ধরনের একটি বিধান করা যেতেই পারে। তবে সংবিধানে ভবিষ্যতে এর বৈধতা দিতে হবে।
প্রসঙ্গত, গণরোষে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তিনি পদত্যাগ করায় মন্ত্রিসভাও ভেঙে গিয়েছে। তারপর সংসদ ভেঙে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। ফলে দেশ পরিচালনার জন্য যে ধরনের সাংবিধানিক সরকার কাঠামো দরকার হয়, সেটি বাংলাদেশে নেই। সেই কারণে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরপরই সংসদ ভেঙে দিয়ে দ্রুত অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠকে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নাম চূড়ান্ত হয়। যদিও বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বলে কোনো ব্যবস্থার উল্লেখ নেই। তবে একটি ব্যবস্থার কথা আগে বলা ছিল, যেটি ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নামে পরিচিত। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান-সংবলিত বাংলাদেশের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন আইন, ১৯৯৬ সালে পাস হয়। এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই বাংলাদেশে তিনটি নির্বাচন হয়েছিল। তবে উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করায় ২০১১ সালে এই ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধান সংশোধন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
উল্লেখ্য, গণ-অভ্যুত্থানে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ সরকারের পতনের পর পঞ্চম সংসদের নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিন মাসের অন্তর্বর্তীকালীন বা অস্থায়ী একটি সরকার গঠন করা হয়েছিল। সেই সময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিল। সেই কারণে বিচারপতি আহমদকে প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং এরপর তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই বিষয়টি বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯৯১ সালে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পঞ্চম সংসদে এই সংশোধনী পাস করা হয়। বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ক্ষমতায় থাকা সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ওই সরকারই বিজয়ী রাজনৈতিক দল বা জোটের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।
এদিকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় শ্রম আদালতের দেওয়া কারাদণ্ড থেকে খালাস পেয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের করা এই মামলায় গত ১ জানুয়ারি গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছ’মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয় ঢাকার শ্রম আদালত। এ ছাড়া প্রত্যেককে ৩০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। রায়ের বিরুদ্ধে গত ২৮ জানুয়ারি আপিল করেন মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজন। তাঁদের আইনজীবী জানান, শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রম আপিল মামলা নিষ্পত্তি করার কথা দু’মাসে। কিন্তু আট মাসেও ড. ইউনূসের আপিল নিষ্পত্তি হয়নি। এই জন্য ১ আগস্ট ড. ইউনূস ও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে যৌথভাবে আপিল মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির আবেদন করা হয়। আদালত বুধবার শুনানির দিন ধার্য করেন। পরে শুনানি নিয়ে আদালত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. ইউনূসসহ চারজনের আপিল মঞ্জুর করেন। অর্থাৎ মামলা থেকে ড. ইউনূসসহ চারজনই খালাস পেয়েছেন।