আল্পস পর্বতমালার উচ্চতা যত, পেরুর লা রিনকোনাডা শহরের উচ্চতা তার চেয়েও ১০০০ ফুট বেশি। শহরটিতে ৫০ হাজার মানুষের বসবাস। এখানে জড়ো হওয়ার পেছনে একটাই কারণ স্বর্ণ, ইনকারা যাকে বলত ‘সূর্যের ঘাম’! এত উঁচুতে হওয়ায় লা রিনকোনাডার বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ খুব কম। সেই সঙ্গে প্রচন্ড ঠান্ডা আবহাওয়া, হিমাঙ্কের কয়েক নিচে তাপমাত্রা। চারদিকে ধূসর পাথর, সাদা বরফ, সবুজের লেশ মাত্র নেই। কিন্তু, এই প্রতিকূল পরিবেশেই গড়ে উঠেছে জনবহুল একটি শহর। আর এটা হয়েছে সোনার প্রতি মানুষের সেই চিরন্তন আকর্ষণের কারণে। এখানে প্রথমে সোনার খোঁজ পায় ইনকারা। ইনকাদের অনুসরন করে স্বর্ণলোভী স্প্যানিশরা, যারা পৃথিবী জয় করতেই বেড়িয়েছিল স্বর্ণ আর হীরা-মুক্তার খোঁজে। লা রিনকোনাডা এমন একটি জায়গা, যেখানে স্বর্ণ সন্ধানীরা নিশ্চিতভাবে জানে স্বর্ণ আছে। এটি এমন একটি জায়গা যেখানে সব কিছুই আবর্তীত হয় সোনা ঘিরে। ভূ-তত্ববিদদের মতে, এখানে এখনও কয়েকশ কোটি ডলারের বেশি দামের সোনা রয়েছে। কিন্তু সেই সোনা হাতে পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়।
লা রিনকোনাডায় অসংখ্য ছোট বড় স্বর্ণ খনি রয়েছে। এখানে পাহারের গা থেকে বা খোলা জায়গায় মাটি সরিয়ে যেমন আকরিক সংগ্রহ করা হয়, আবার সুরঙ্গ কেটে পাহারের ভেতরে ঢুকে সেখান থেকেও আকরিক সংগ্রহ করা হয়। এখানে সোনার সন্ধানে যুগের পর যুগ ধরে পাহাড়ে মাইলের পর মাইল সুরঙ্গ কাটা হয়েছে। সুরঙ্গের ভেতরের বাতাসে অক্সিজেন অল্প, ডিনামাইট বিস্ফোরোনের কারণে যেমন ধুলো আর বিষাক্ত গ্যাস- জীবনের ঝুঁকি নিয়েই শ্রমিকেরা কাজ করে যান। পাথর ধসে সুরঙ্গ বন্ধ হয়ে শ্রমিকদের আটকা পড়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। প্রায়ই ঘটে মৃত্যুর ঘটনাও। কিন্তু তবু সোনার জন্য মানুষ কাজ করে চলে। এখানে খনিতে কাজ হয় সেই মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিতে, একশ দেড়শ বছর আগে যেভাবে সোনা উত্তোলন করা হত, সেই পদ্ধতিই চালু আছে। শ্রমিকদের কাজ করতে হয় অস্বাস্থ্যকর আর ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে। ছোট একটি আংটিতে যে পরিমাণ সোনা লাগে তা সংগ্রহ করতে পাহাড় কেটে সড়াতে হয় ২৫০ টন পাথর!
এই পদ্ধতিতে শ্রমিকরা খনিতে ৩০ দিন বিনা বেতনে কাজ করেন। তারপর তাদের চার ঘন্টা বা তার কিছু বেশি সময়ের একটা সুযোগ দেওয়া হয়। তার মধ্যেই শ্রমিকরা বস্তায় করে যত খুশি আকরিক খনি থেকে নিয়ে যেতে পারবেন। আর সেই সুযোগ তারা পাবেন মাত্র একবার এবং বস্তা বহনের জন্য কোনো যানবাহন ব্যবহার করতে পারবেন না। অর্থাৎ শারীরিক শ্রমে যতটুকু নেওয়া যায়। সারা মাস অমানবিক শ্রমের বিনিময়ে শ্রমিকরা বস্তায় করে আকরিক থেকে সামান্য সোনা মিলতেও পারে আবার নাও পারে। কিন্তু তাহলেও তারপরও অসংখ্য শ্রমিক লা রিনকোনাডা শহরে ভীড় জমাচন। একদিকে বেকারত্ব, অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী সোনার দাম ক্রমাগত বেড়ে চলা- এই দুই কারণে মানুষ এখানে ছুটে আসে। কিন্তু এই প্রতিকূল পরিবেশে কেউ স্থায়ীভাবে থাকার জন্য আসে না। সবাই আসে অস্থায়ীভাবে থেকে ভাগ্য গড়ার জন্য। এই শহরে নেই কোন বিশুদ্ধ জল সরবারাহ ব্যবস্থা, নেই পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, নেই বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা। এটা এমন একটি শহর যে শহরে হোটেল নেই, রেস্তোরা নেই, শপিংমল নেই, হাসপাতাল নেই, স্কুল নেই, বাসস্টপ নেই, রেল স্টেশন নেই। শুধু তুষার ভূমিতে পরিকল্পনাহীনভাবে ছোট ছোট ঘরের পর ঘর। চারপাশে খোড়াখোড়ির চিহ্ন, কোথাও বিশাল বিশাল সব গর্ত। কাদায় মাখামাখি পুরো শহরটাই যেন বিরাট একটি বস্তি!
লা রিনকোনাডায় বেশ কিছু মহিলাও থাকে। এরা মূলত লা রিনকোনাডায় ঘুরে ঘুরে সোনা খুঁজে বেড়ায়। তাদের বলা হয় পাল্লাকুয়েরাস। তবে এদের খনির ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই। ওখানকার বিশ্বাস, মেয়েরা খনিতে ঢুকলে অমঙ্গল হয়। খনি থেকে উত্তোলিত পাথর থেকে সোনাসহ বিভিন্ন ধাতু আলাদা করে ফেলার পর সেগুলো খনির বাইরে ফেলে দেওয়া হয়। এরা সেই ফেলে দেওয়া পাথরের স্তূপ ঘেঁটে বেড়ায়, তাতে কোনো সোনা বা দামি ধাতু পাওয়া যায় কি না। ওখানে এই পাল্লাকুয়েরাস আছে প্রায় হাজার জন। এদের বেশিরভাগই খনিতে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের স্ত্রী।এত উঁচুতে বসবাস করার কারণে তারা যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে না। তারপরও মানুষগুলো শুধু সসোনার লোভে বছরের পর বছর এখানেই পড়ে থাকে।