বিখ্যাত উর্দু কবি ও গীতিকার শাকিল বাদাঁয়ু যে গ্রামে জন্মেছিলেন পরবর্তীতে সেই গ্রামের নাম হয় বাদাঁয়ু। উত্তর প্রদেশের বরেলীর কাছে সেই গ্রামেই জন্মেছিলেন উস্তাদ রশিদ খান। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে রশিদ খানের পরিবারের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এই পরিবারের বরেণ্য সঙ্গীত শিল্পী উস্তাদ এনায়েত হুসেন খান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘রামপুর-সহসওয়ান’ ঘরানা। বাবা হামিজ রেজা খান, পরবর্তীতে দাদু উস্তাদ নিসার হুসেন খানের কাছে তার প্রাথমিক সঙ্গীত শিক্ষা সম্পন্ন হয়। যদিও গানের নিয়মিত চর্চার থেকে ফুটবল খেলাতেই ছিল রসিদের বেশি মনোযোগ।এরপর দাদুর হাত ধরে কলকাতা আই টি সি সঙ্গীত একাডেমিতে আসা এবং এখানেই শুরু হয় তাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা । এখান থেকে বেশ কয়েক বছরের শিক্ষা শেষ করে তিনি পরিপূর্ণ সঙ্গীতশিল্পী রূপে আত্মপ্রকাশ করেন।
ছোটবেলাতেই অভাবনীয় পারদর্শিতায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গায়নে দ্যুতিময় মেধার পরিচয় দিয়েছিলেন, পেয়েছিলেন খ্যাতনামা ও প্রবীণ সঙ্গীতজ্ঞের আশীর্বাদ। পণ্ডিত ভীমসেন যোশী মুক্তকণ্ঠে তাঁকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আধুনিক যুগে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসিয়েছিলেন। উস্তাদ রশিদ খানের গুণমুগ্ধ ছিলেন পণ্ডিত রবিশংকর । শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গায়নের প্রেক্ষিতে উস্তাদ রশিদ খানের অনন্যতা হল তিনি মূলত রামপুর সহসওয়ান ঘরানার হলেও ঘরানাকেন্দ্রিকতায় তিনি কখনো আটকে থাকেন নি। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিভিন্ন ঘরানার চমৎকারিত্ব তাঁর কণ্ঠে মিলে মিশে এক মোহনীয় রূপ ধারণ করেছিল। রামপুর সহসওয়ান ঘরানার সঙ্গে গোয়ালিয়র ঘরানার বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। পূর্ণ গম্ভীর স্বর ও সুর, মধ্য এবং ধীর লয়ের সঙ্গীতে তান ও বিস্তারের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শৈল্পিক কারুকার্য রশিদের ঘরানাকে আলাদা মাত্রা দিয়েছিল। এর পাশাপাশি উস্তাদ রশিদ খান বিলম্বিত খেয়াল গায়নে তাঁর দাদুর কাছ থেকে শেখা ব্যতিক্রমধর্মী গায়কীর সঙ্গে সরগম ও সরগম তানকারীর মিশেল ঘটিয়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে স্বতন্ত্রতার সাক্ষর রাখেন যা অত্যন্ত চমৎকার ও অভাবনীয়। রশিদকে ইন্দোর ঘরানার প্রবাদপুরুষ উস্তাদ আমির খাঁ ও পণ্ডিত ভীমসেন যোশীর কিরানা ঘরানার গায়কী প্রবলভাবে আকৃষ্ট করতো। তাঁর গায়কীতে এই দুই মহারথীর প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। এভাবেই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তোর মতো সকল অনন্য গায়নরীতিকে নিজের মতো করে তিনি একত্র করে সৃষ্টি করেছেন অনবদ্য সঙ্গীত মূর্ছনার।
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রশিদের অনন্যতা কেবল খেয়াল গানেই নয়, তারানাতেও তিনি তার অনবদ্য পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করেছেন। দাদু উস্তাদ নিসার হুসেনের কাছ থেকে শেখা তারানা পরিবেশনের অনন্য শৈলীকে তিনি নিজের সৃষ্টিশীলতা দিয়ে কারুকার্যমণ্ডিত করে পরিবেশনের মাধ্যমে প্রতিটি তারানাকে পৌঁছে দিয়েছেন এক অন্য উচ্চতায়। তাঁর গায়কীর আরেকটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রাগের চলন অনুযায়ী কঠোর নিয়মে বাঁধা সুরকে নিয়ে যেমন খেলা করেছেন, পাশাপাশি বন্দিশ কিংবা আলাপের সময় আবেগের স্নিগ্ধ স্পর্শ দিয়েও সঙ্গীতকে স্পর্শ করেছেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কঠিন নিয়মের বেড়াজালে থেকে সুরের কারুকার্যের সেই সাবেকিয়ানাকে ঐতিহ্য বজায় রেখে আধুনিক করেছেন।শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রশিদদের আরেকটি অবদান ভাবগাম্ভীর্যময় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকে অন্যান্য লঘু সঙ্গীত ধারার সঙ্গে মিশিয়ে বেশ কিছু চমৎকার গবেষণাধর্মী সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। যেমন আমীর খুসরোর “নায়না পিয়া সে” গানটিকে তিনি পরিবেশন করেছেন সুফি ঢঙ্গে। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সঙ্গে ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতের এক নতুন ধারা তৈরি করতে লুই ব্যাংকসের সঙ্গে যুগলবন্দীর এক অসাধারণ নজির গড়েছেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিল্পী হলেও তিনি বেশ কিছু ফিল্মের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। স্মরণীয় হয়ে থাকবে ইরশাদ কামিলের রচনায় সন্দেশ শান্ডিল্যের সুরে “যব উই মেট” ছবিতে ‘আওগে যব তুম সজনা’ গানটি। বড় বেদনার মতো বাজবে ‘দ্য লাস্ট লিয়র’ ছবির মিয়াঁ কি মল্লারের আশ্রয়ে তাঁর উদাত্ত আলাপ!
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গায়ক হয়েও রশিদ যেমন আশ্চর্য ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিলেন বলিউডের বেশকিছু সিনেমার গান গেয়ে তেমনই উত্তর প্রদেশে জন্ম হলেও উস্তাদ রশিদ খান ছিলেন আদ্যোপান্ত বাঙালি। এবং তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন তিনি একজন বাঙালি। এই কারণেই পদ্মশ্রী পুরস্কার নেওয়ার সময় তাঁকে উত্তরপ্রদেশের শিল্পী বলে উল্লেখ করায় তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাতেই ছিলেন তাই যেখানেই তিনি যেতেন নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতেন। এবং বাঙালিদের মতন পান খেতে ভালবাসতেন তিনি।