জন্মের পর থেকেই আমরা কোনো না কোনো ভাবে পার্শিয়ালি চ্যালেঞ্জড। বোধহয় একই ভাবে বিশেষভাবে সক্ষম বলা চলে আজকের পরিভাষায়। সকাল প্রায় ন’টা। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িয়েছি হাওড়া যাওয়ার একটা টিকিট কেটে। এদিকে ব্রিগেডের দিন। মীনাক্ষী সেলিমের দিন। তবে স্বস্তি যে ঝান্ডা পার্টি কাউকে দেখিনি। কেউ রাগ করবেন না যেন। গোপালদার স্টলে এসে দাঁড়ালাম। ম্যাগাজিন কাগজ বিক্রি করে গোপালদা মাটিতে প্লাস্টিক বিছিয়ে, ওর বয়েস প্রায় পঁয়ষট্টি হবে। রেলের স্টলটা ওরই ছিল বছর পাঁচেক আগেও। ভাড়া বাকি পড়া দেনা এসবের উপদ্রবে গোপাল হাটাও করে সেটা এখন বন্ধ সুতরাং প্ল্যাটফর্মের দশফুট বাই ছ’ফুট জুড়ে ওর দোকান। ওর কাছে আগে কাগজ নিতাম এখন নিইনা। কে পড়ে? গত পরশুও একটা ম্যাগাজিন চেয়ে নিয়ে গেলাম আমার লেখক কপি। প্রকাশকের বলা ছিল। এখন একজন উবু হয়ে বসে কয়েকটা চটি বই আলাদা করে রেখেছে কিনবে বলে। উৎসাহ নিয়েই এগিয়ে দেখলাম বিশুদ্ধ নিত্যকর্ম পদ্ধতি, বশীকরণ তন্ত্রম, হনুমান চালিশা। মোট তিন পিস। দেখে আমার একটা বিদ্রুপ মেশানো মজা পেলো। ট্রেন ধরবো তাই এগিয়ে গেলাম। মজা পাওয়ার কারণ খুঁজতে লাগলাম পরে যখন ট্রেনে চেপে পড়েছি কিন্তু জায়গা না পাওয়ার অ-সুখ টুকু মাথায় রয়ে গেছে তবে ব্যান্ডেল আসতে ট্রেন প্রায় অর্ধেক ফাঁকা। ভেবে খুঁজে পেলাম ওই বিদ্রুপ মেশানো চাপা হাসিভাবের উদ্রেক বা উপদ্রবটাই আমার নিজের কাছে চ্যালেঞ্জ। আমি ওটা মেনে নিতে অসম্মত। আমার নিজের প্রতিবন্ধকতা কত কত যে আছে সেটা প্রকাশ্যে বলতে সাহস পাইনা। লজ্জায় বলিনা।
এক বন্ধু বিপ্লব চৌধুরীর কবিতা সমগ্রের যে খন্ডটা আমার কাছে আছে সেটা পড়তে চেয়েছে সঙ্গে সতীনাথ ভাদুড়ীর ঢোঁড়াই-টাও নিতে হবে ওরই কপি। সঙ্গে নিয়েছি তো? সেটা ব্যাগে হাত ঢুকিয়ে একবার চেক করে নিলাম। বিপ্লবের নাম ওই পড়ুয়া আমার কাছে খুব শুনেছে। আমার সময়ের একজন ভালো কবিতা লিখিয়ে ও পড়ে দেখতে চেয়েছে। খুব রাগ অভিমান জমে আছে আমার বিপ্লবের ওপরে। সে থাক সেসব এখানে বেশি বলার নয়। ইদানিং কেউ কারোর যোগাযোগ রাখিনা। ওর আমার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় কেটেছে অনেকগুলো বছর। ওর কবিতাগুলো পড়াতে চাই বন্ধুদের। এই যে আমি ভালো লিখতে পারিনা বলে ওর সম্পাদনা করা পত্রিকায় এখন আমার কোনো স্থান হয়না। কত কত কবি ঢল দিয়ে নেমে আসছে সবার তো আর কূল কী পাড় পাওয়ার সুযোগ নেই। এটাও তো একটা চ্যালেঞ্জ। নয় কী! এভাবেই স্থূল শিথিল ত্যাজ্য হয়ে পড়ে এক একটা জীবনে সেসব ঘটনা হিসেব কষতে যাওয়াও একটা চ্যালেঞ্জ বা অক্ষমতা। আসলে যা বলতে চাই কবির থেকেই ধার করে বলি, যে লেখে সে আমি নয়। বরং আমাকে একটু ভালোবাসুন।
উল্টোডাঙায় এসে বিপ্লবী বারীন ঘোষ রোড ধরে হাঁটছিলাম মুরারীপুকুরের দিকে। এদিকটায় কোনদিন আসিনি। কথা বলতে গিয়ে এ জায়গার অতীত শুনছিলাম। বুঝলাম এখন চারিদিকে দখল হয়ে গেছে ইমারত আর নাগরিক খুপরিতে। বড় জলাশয় বুজিয়ে বাস্তুতন্ত্র হাওয়া নতুন মানব কল্যাণে। স্পষ্ট চোখে পড়ে হাঁটতে হাঁটতে এগোলে। চাক্ষুষ দেখলাম লিলি বিস্কুটের কারখানার ধ্বংসস্তূপ কোন শোরগোল ছাড়াই দুর্বিষহ বটের জটা আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। টিকে না থাকতে পারার অক্ষমতায় এও কী এক চ্যালেঞ্জ-এর মধ্যে হাড়গোর নিয়ে খাঁড়া হয়ে আছে। তবু বিভিন্ন রঙের পতাকার ডাকে মানুষ কিন্তু ব্রিগেডে দাঁড়ায় ঝড় জল শীত বা রোদে।
সন্ধেবেলা এক বন্ধুকে ফোন করেছিলাম। একথা ওকথার পর ভাষা ও বানান বিষয়ে খুব মেটিকিউলাস সে বন্ধু বললে ইদানিং ওর চোখে ফেসবুকের নব্বই শতাংশ লেখায় নানা ভুল ধরা পড়ে সে বানান বা বাক্য গঠন যাই হোক। আমার লেখাতেও অনেক বানান ও শব্দের ব্যবহারের ত্রুটি দেখেছে যদিও এ নিয়ে আমাদের কথাও হয়েছে। আমাকে অভিধান ব্যবহারের অভ্যাস করতে বলেছে কিন্তু আমার অভিধান তো ধুলো পড়ে স্তূপের নীচে। এবার বার করা সত্যিই প্রয়োজন। তারপর ওকে আমি আমার বাংলা টাইপ করার প্রযুক্তিগত অক্ষমতার কথাও বলেছি। সে যাই হোক এটা জেনেছি হিমানীশ গোস্বামীর ‘অভিধানাই পানাই’ নামে সরেস এক রচনা আছে যেটা আমাকে জোগাড় করে পড়তেই হবে। এসবের সন্ধান পাই তারাপদ রায়ের অ-গোপনীয় সব লেখাপত্তর থেকে। শেষ বেলাটা ড্রাই-ডে তে শেষ করি তারাপদবাবুকে নিয়েই যদিও এটিও হিমানীশবাবুরই পথ দেখানো।
অযোধ্যা সিং নামে এক প্রেমে ব্যর্থ যুবক মনের দুঃখে বোতলের পর বোতল রাম নামক মদ্য পান করতে করতে মরে যায়। তার আত্মীয়রা তাকে বোতলসুদ্ধ শ্মশানে পুড়িয়ে দেয়। অনেকে আপত্তি করে, অসম্ভব রাম খেয়ে মৃত্যু হতে পারেনা বড়জোর বমি করতে পারে সুতরাং এর তদন্ত হাওয়া উচিত। তার পরিবারের লোকেরা উত্তর দেয়, অযোধ্যাকে রামের বোতলগুলোসুদ্ধ পুড়িয়ে দিয়েছি। এখন সে রামও নেই অযোধ্যাও নেই আমরা কিছু প্রমাণ করতে পারবো না।