তিনি কি নারীবাদী ছিলেন? জীবনস্মৃতির খাতায় তিনি বলেছেন, মেয়েদের কথাই বেশি করে ভেবেছেন। কারণ তাদের অসহায় অবস্থা চোখে পড়েছে বেশি, তাদের অবরোধ সমস্যাই তাঁকে সবচেয়ে বেশি পীড়িত করত। ছোটবেলা থেকে তিনি দেখছেন সেই মেয়েদের বন্ধনদশাগ্রস্ত অবস্থা। তাছাড়া মেয়েদের সব বিষয়েই তো ছিল অনধিকার। কিন্তু তিনি যে সব সময়েই নারীদেরর পক্ষে বলেছেন তেমনটা তো নয়, তিনি নারীদের প্রতি সব সময়ে পক্ষপাতিত্ব করেন নি, তাদের শাসন করেছেন, সমালোচনা করেছেন। আবার বলেছেন, পুরুষেরা ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারে। মেয়েরা কি তা পারে? মেয়েদের অধিকার, বন্ধন ইত্যাদি প্রশ্ন তুলে লিখেছেন ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি, ‘সুবর্ণলতা, ‘বকুলকথা’।
ছোটবেলা থেকেই ‘মেয়েমানুষের’ দাবি নিয়ে কথা বলতো যে মেয়েটি তাঁর নাম সত্যবতী (‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’)। সে বলছে- ‘এত যদি না দরকারের কথা তো মেয়েমানুষের জন্মাবারই বা দরকার কি…?’ তাঁর মুখেই পড়েছি- ‘বলি স্বয়ং মা সরস্বতী নিজে মেয়েমানুষ নয়? সকল শাস্তরের সার শাস্তর চার বেদ মা সরস্বতীর হাতে থাকে না?’ ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’তেই প্রথম লেখিকা সত্যবতীর মুখ দিয়ে মেয়েদের আত্মভিমান নয় আত্মসম্মানের কথাগুলি বলালেন, অনেক কালের চাপা বিদ্রোহের ইঙ্গিত দিলেন। কেবল তাই নয়, সত্যবতী স্বামী, সংসার ত্যাগের পর জানান যে সে স্কুলের শিক্ষয়িত্রী হয়ে পেট চালাবেন। কারোর কাছে হাত না পেতে তার নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা যে মেয়েদের বন্ধনমুক্তির কেন্দ্রবিন্দু- সেটি স্পষ্ট তুলে ধরলেন। আশাপূর্ণা দেবী সময়ের অনেক আগেই ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’তে মেয়েদের মুখেই মেয়েদের স্বাধীনতার দাবি জানালেন। অবরোধ ভেঙে ফেলার কথা বললেন।
সত্যবতীর মেয়ে সুবর্ণলতা, এই মেয়ের কথা পড়ছি ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’-র পরে ‘সুবর্ণলতা’য়। এই মেয়েও সোচ্চার, অলজ্জ, মায়ের থেকেও তীব্র। এতটাই ভীষণা যে মেয়েদের অসম্মানের লাঞ্ছনায় সেই মেয়ে এই হতভাগা দেশের মেয়েদের জন্য সজোড়ে ‘মড়ক’ প্রার্থনা করে বলে—‘বাংলাদেশের মেয়েদের ওপর এমন কোনো মড়ক আসে না গো, যাতে দেশ মেয়ে-শুন্যি হয়ে যায়? তখন দেখি তোমরা মহানুভব পুরুষসমাজ কোন সিংহাসনে বসে ক্রীতদাসী সংগ্রহ কর?’ পুরুষের একচেটিয়া অধিকারের অহঙ্কার নিয়ে সে প্রশ্ন তুলেই ক্ষান্ত দেয় না, অভিশাপ দেয়, ‘তোমাদেরই জুতোর শুকতলা ক্ষয়াতে হবে’। এ কি কেবল অভিশাপ?
‘বকুলকথা’য় পড়ছি সুবর্ণলতার সবচেয়ে ছোট মেয়ে বকুলের কথা। এই মেয়ে তাঁর মা কিংবা দিদিমার মতো নয় মোটেও, বরং অনেকটাই বিপরীত প্রকৃতির। সত্যবতীর নাতনী বা সুবর্ণলতার মেয়ে ছোট মেয়েটি যেমন মুখচোরা তেমনই চুপচাপ, নিজের মধ্যেই পুরোটা গোটানো পাকানো। অথচ এই সর্বংসহা, শব্দহীনা মেয়েটি একদিন হয়ে ওঠে স্বনামধন্য লেখিকা ‘অনামিকাদেবী’। আশাপূর্ণার নিজের কথা অনুযায়ী বকুল ‘সুবর্ণলতা’র পরিপূরক। বকুলের মধ্য দিয়েই সত্যবতী ও সুবর্ণলতার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়। বকুল কেবল খ্যাতনামা কথাকার নয়, সে রাস্তাতেও নামে, স্বশব্দে ফেটে পড়ে না ঠিকই কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে—“মা, মা গো! তোমার পুড়ে যাওয়া হারিয়ে যাওয়া লেখা, না-লেখা সব কথা আমি খুঁজে বার করবো। সব কথা আমি নতুন করে লিখবো। দিনের আলোর পৃথিবীকে জানিয়ে যাবো অন্ধকারের বোবা যন্ত্রণার ইতিহাস।’’
গত শতকের সাতের দশকের মাঝামাঝি সময় আমাদের দেশের মেয়েদের পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম রিপোর্ট (Status of Women in India) প্রকাশিত হবার পরই ভারতীয় নারীবাদী আন্দোলন শুরু হয়েছিল বলে ধরা হয়। কারণ, তখন থেকেই ভারতীয় নারীবাদের তত্ত্ব ও দাবী প্রসঙ্গ জোরদার হয়ে ওঠে। কিন্তু তার অনেক আগে আশাপূর্ণা দেবীর ট্রিলজি, যেখানে মেয়েদের অধিকার, স্বাধীনতা, অবরোধ, দাবি সহ আরও নানা প্রসঙ্গ আত্মপ্রকাশ করে তিনটি উপন্যাসের তিন প্রজন্মের নারীর মধ্যে দিয়ে। ঔপনিবেশিক সময় থেকে স্বাধীন ভারতে বাঙালি সমাজে নারীর অবস্থিতির জ্বলন্ত সাক্ষ্যী সত্যবতী, সুবর্ণলতা এবং বকুল- মা, মেয়ে ও নাতনিকে সময় ও সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে যৌথভাবে নারীবাদ বিবর্তনের আলেখ্য বলা যায়।
কিন্তু আশ্চর্য হতে হয় যখন আশাপূর্ণা দেবীর ‘ছিন্নমস্তা’ গল্পটি পড়ি। বিধবা মা জয়াবতী যখন দেখেন ছেলের বিয়ের পর নতুন যুবতী বউ তাঁর একমাত্র ছেলেকে দখল করে নিয়েছে, তিনি আর তখন তাঁর ভিতরের ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে একমাত্র সন্তানের মৃত্যুকামনা করে বসেন। কেন আশাপূর্ণা এখানে মা জয়াবতীকে সত্যবতী, সুবর্ণলতা কিংবা বকুলের এতটা বিপরীত প্রকৃতি দিলেন? এই গল্পের পরই এসে পড়ে ‘পরাজিত হৃদয়’ গল্পটির কথা। একমাত্র আদরের মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়। কোনোক্রমে বেঁচে গিয়ে সে বাড়ি ফেরার জন্য তাঁর মা অমলাকে চিঠি লেখে। কিন্তু মা অমলা মেয়ের সেই চিঠি পড়ে রান্নাঘরে গিয়ে তক্ষুনি তক্ষুনি ‘জ্বলন্ত উনুনের আগুনে গুঁজে দেয়’। কেন মা হয়েও মেয়ের অস্তিত্ব এভাবে ভুলে যেতে চান অমলা। আবার আশাপূর্ণার গল্পের অনেক নারীচরিত্রকে আত্মবিলাপের মধ্যে দিয়ে মহত্ত্ব অর্জন করতেও আমরা দেখি ।
‘ভয়’ গল্পে সাতটি-সন্তান মারা যাওয়ার পর বৃদ্ধা মা সাহেব ডাক্তার দেখাতে চান। মৃত্যুভয়ের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায় তার সন্তান হারাবার দুঃখ। ‘আয়োজন’ গল্পে নাতির প্রতি দাদুর স্নেহ এবং শিশুটির মায়ের মনযোগ এক অন্য মাত্রার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে। এখানেও নাতির মৃত্যুকামনার মধ্যে দিয়ে দাদুর মনের তীব্র অহংতৃপ্তির বাসনার নগ্ন রূপ ফুটে ওঠে। এই ভাবে বিভিন্ন সামাজিক ও মানসিক পরিস্থিতির চাপে আশাপূর্ণার গল্পে আমরা মানবিক সম্পর্কগুলিকে নির্মমভাবে ভেঙে যেতে দেখি। ‘স্মৃতিমন্দির’, ‘কসাই’, ‘স্থিরচিত্র’ প্রভৃতি গল্পেও তার প্রমাণ আছে।