“আমি ডাকাত ছিলাম না। আমি ছিলাম ‘বাগি’ (বিদ্রোহী), আত্মমর্যাদা আর আত্মরক্ষার তাগিদে আমি বন্দুক হাতে নিয়েছিলাম। আসল ডাকাত কারা তাদের আমি চিনি আর এও জানি কীভাবে তাদের মোকাবেলা করতে হয়,”।একথা বলেছিলেন মালখান সিং। তিনি ছিলেন চম্বল উপাখ্যানের চিরায়ত এক নায়ক। নিম্ন বর্ণের এই তরুণ বলেছিলেন তার ওপর অত্যাচার চালানো উচ্চ বর্ণের এক হিন্দুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে তিনি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন।

জানা যায়, মালখান সিং ছিলেন লম্বা, হালকা পেটানো শরীর, ঝোলানো গোঁফ, গম্ভীর, স্বল্পভাষী, কাঁধে ঝোলানো বেলজিয়ান বন্দুক। খুব কম কথা বলতেন, কিন্তু অহঙ্কারী এবং সম্মান কাড়ার মত ব্যক্তিত্ব। তার দলে ছিল প্রায় দু-ডজন দস্যু। তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত রাতের অন্ধকারে। তাদের সঙ্গে থাকতো চাদর কম্বল, অস্ত্র, বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে কিছু ত্রিপল আর সাধারণ কিছু খাবারদাবার। তারা ঘুমাত খোলা আকাশের নীচে। তাদের একজনের কাছে থাকত একে-৪৭ বন্দুক। অন্যরা ব্যবহার করত হালকা স্বয়ংক্রিয় বন্দুক আর রাইফেল।

মধ্যপ্রদেশের চম্বল এলাকা একসময় ছিল কুখ্যাত আর দুর্ধর্ষ দস্যুদের আবাসভূমি। এখানে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন “দস্যু রানি” ফুলন দেবী। তাকে গণধর্ষণ করার বদলা নিতে তিনি উচ্চ বর্ণের ২২ জন হিন্দু পুরুষকে একসঙ্গে হত্যা করেন। এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে দস্যু রানি হিসাবে তিনি কুখ্যাত হয়ে ওঠেন। তবে চম্বলে মালখান সিং ও তার দলবল ছিল সবথেকে ভয়ঙ্কর এবং ত্রাস সৃষ্টিকারী। তারা পায়ে হেঁটে পথ চলতে চলতে ডাকাতি করে বেড়াত। দুর্গম গিরিখাতে, যেখানে গভীর আর সরু খাদের চারপাশ দিয়ে উঠে গেছে খাড়া পাহাড়, সেসব জায়গায় তাঁবু গেড়ে তারা অস্থায়ী আস্তানা বানাত।

মালখান সিং-এর ১৩ বছরের রাজত্বে যখন তার রমরমা প্রতাপ, তখন তার দলে দস্যুর সংখ্যা ছিল ১০০জন। প্রতিপক্ষ ডাকাতরাই তাকে “দস্যু সম্রাট” উপাধি দিয়েছিল। পুলিশ ১৯৮২ সালের মধ্যেই তার ডাকাত দলের বিরুদ্ধে ৯৪টি মামলা করেছিল, যার মধ্যে ডাকাতি ছাড়াও ছিল অপহরণ আর হত্যার অভিযোগ। মালখান সিংকে ধরিয়ে দেবার জন্য ৭০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। সরকার অস্ত্র সমর্পণের জন্য মালখান সিং-এর কাছে বেশ কয়েকবার প্রস্তাবও পাঠিয়েছিল। শেষমেশ ১৯৮২ সালে প্রশান্ত পাঞ্জিয়ার আর তার দুই সহকর্মী কল্যাণ মুখার্জি আর ব্রিজরাজ সিংকে লাগানো হল সরকার ও মালখান সিং-এর দস্যুদলের মধ্যে আত্মসমর্পণ করার আলোচনায় মধ্যস্থের ভূমিকা পালনের জন্য। আর সেই বছরই জুন মাসে কয়েক হাজার মানুষের সামনে মালখান সিং এবং তার দলের দস্যুরা আত্মসমর্পণ করেন।

মালখান সিং আত্মসমর্পণের সময় ভারত সরকারের কাছ থেকে শর্ত আদায় করেছিলেন, তার দস্যু দলের কোনো সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না। এই শর্তে ভারত সরকার রাজী হওয়ায় মালখান বিজয়ী বীর হিসাবে মঞ্চে উঠে আসেন। সেদিনও লম্বা, পাতলা, ঋজু চেহারার মালখানের পরনে ছিল পুলিশের ইউনিফর্ম। তবে সেদিন বহু বছর ধরে অস্ত্র হাতে এলাকা কাঁপিয়ে বেড়ানো দস্যু সম্রাট মালখান সিং মধ্য প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে ভিন্দ শহরে ৩০ হাজার জনতার উপস্থিতিতে অস্ত্রকে শেষ বিদায় জানান। তার এই আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানকে রোম্যানদের বিজয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে তাদের প্রতিবেদনে তুলনা করেছিল ‘ইন্ডিয়া টুডে’।

প্রশান্ত পাঞ্জিয়ার বলছিলেন মালখান সিংয়ের একটা অদ্ভুত শুষ্ক রসবোধ ছিল। আত্মসমর্পণের পর সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরে বারবার হিন্দিতে গতানুগতিক একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন: আপ কো কৈসা লাগ রাহা হ্যায়? প্রশান্ত পাঞ্জিয়ার আর তার সহকর্মীদের দিকে উল্টে সেই প্রশ্নটাই ছুঁড়ে দিয়েছিলেন মালখান সিং। উরু চাপড়ে বলেছিন, “ডাকাত বলবেন না, বলুন বাগি। পান, বিড়ি, মদ ছুঁইনি। মহিলাদের অত্যাচার করিনি। নেতাদের বিরুদ্ধে কুড়িটি করে মামলা, ডাকু তাঁরা। আমি তো আত্মসমর্পণ করেছি, ওঁরা করবেন?” তার পর দু’হাত ছড়িয়ে বলছিলেন, “কী আছে আমার? ভিন্দে দশ-কুড়ি বিঘা জমি আর গ্বালিয়রে দু’কামরার ঘর। ডাকু হলে সম্পত্তি করতাম না?” পরে মালখান সিং এবং তার দলের দস্যুদের বিরুদ্ধে আনা কিছু কিছু অভিযোগে তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তাদের “উন্মুক্ত কারাগারে” সাজা খাটার জন্য রাখা হয়। মালখান সিং নিজেও কয়েক বছর জেলে কাটান।এরপর মালখান সিং রাজনীতিতে যোগ দেন।