(শেষ)
স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু বাঙালিরা সবথেকে বেশি আক্রান্ত হয়েছে ২০০১ থেকে ২০০৬- এই পাঁচ বছর। ২০০১ সালে বিএনপি-জমাত তথা চারদলীয় জোট বাংলাদেশে ক্ষমতায় এসে বলা ভাল ১অক্টোবর নির্বাচনের দিন থেকেই তারা বাংলাদেশের মানুষকে ফিরিয়ে দিয়েছিল ১৯৭১ সালের বর্বরোচিত দিনগুলির স্মৃতি। কারণ, ওই সময় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন অনেক ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালকেও হার মানিয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ৪০. ৯৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ১৯৩টি আসন লাভ করেছিল অন্যদিকে ৪০.১৩ শতাংশ ভোট পেয়ে মাত্র ৬২টি আসন পেয়ে বিরোধি দলের আসনে বসে আওয়ামীলীগ। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে হুমায়ুন আজাদ “পাকসার জমিন সাদবাদ” নামে একটি বই লিখেছিলেন। যেখানে কেবলমাত্র বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দল করার কারনে নগর থেকে শান্ত গ্রাম অবধি লাশের মিছিলের বর্ণনা ছিল। ছিল পুর্ণিমা ধর্ষনের খবর। আর আতংকিত মায়ের উক্তি “বাবারা আমার মেয়েটা ছোট, তোমরা একজন একজন করে যেও”। এই বইটির জন্য হুমায়ুন আজাদকে জীবন দিতেও হয়েছিল।
২০০৬ সালে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক (চতুর্থ) সরকার গঠিত হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার কথা ছিল সেটি লঙ্ঘিত হয়। কারণ, প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মেয়াদ শেষে দায়িত্ব হস্তান্তর না করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদেকে প্রধান উপদেষ্টা পদ গ্রহণে প্ররোচিত করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণও করেন। এই পদ তিনি সংবিধান অনুযায়ী সরাসরি গ্রহণ করতে পারেন না। যাই হোক রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এই সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু উপদেষ্টাদের মধ্যে চার জন এক মাস কাজ করার পর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মতানৈক্যের অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেন। পরবর্তিতে রাষ্ট্রপতি আরও চার নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ করেন। এরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা হয় জানুয়ারি ২২, ২০০৭। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্যসব উপদেষ্টা পদত্যাগ করেন। ফলে রাষ্ট্রপতি জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন।ড. ফখরুদ্দীন আহমদ নতুন প্রধান উপদেষ্টা ও দশজন উপদেষ্টা নিয়ে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজ শুরু করেন একই সঙ্গে ২২ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল হয়। ইতিমধ্যে ২০০৮ সালের ১১ জুন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ৩৩১ দিন কারাভোগের পর মুক্তি লাভ করেন।
মইনুদ্দীন ফখরুদ্দীন সরকারের সময় বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের খবর অনেকটাই চাপা পড়ে আছে।২০০৯ সালে আওয়ামিলীগ ক্ষমতায় ফিরে এলেও সংখ্যালঘুরা শান্তিতে ছিলেন একথা বলা যায়না। ২০১২ সালেও রামুতে বৌদ্ধ পল্লীতে হামলার ঘটনা ঘটেছে৷ ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর আবার নতুন করে আক্রান্ত হল বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা। বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচন বর্জন করলে ভোটার বিহীন নির্বাচনে কিছুকিছু জায়গাই স্বতর্ফুত ভাবে সংখ্যালঘুদের ভোটদিতে দেখা যায় কিন্তু তাতে হিন্দুদের উপর অত্যাচার চলে, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট বিরাট আকার নেয়। ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু বসতিতে বিশাল হামলা হয়। ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়স ফ্রিডমের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে হিন্দুরা অত্যাচারের শিকার হয়েছে বটেই পাশাপাশি ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে বরিশাল, বাগেরহাট, ঝালরকাটি, পিরোজপুর, ভোলা, নারাইল, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ি, মানিকগঞ্জে হিন্দুদের যে বড় জনবসতি ছিল, তা দ্রুত কমতে থাকে। গোপালগঞ্জ, দিনাজপুর, সিলেট, ময়মনসিং, খুলনা, যশোর, চট্টগ্রামে এখনও হিন্দু জনবসতি থাকলেও, তা ক্রমাগত কমছে। বাংলাদেশে হিন্দুদের জনসংখ্যা কমার অন্যতম কারণ হল গণহত্যা, ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, ধর্মীয় হিংসা এবং ধর্ষণকে কার্যত অস্ত্রের মতো ব্যবহার করা।
সাম্প্রতিক কালে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নির্যাতন বেড়েছে যার সঙ্গে সরকারী দলের নেতাকর্মীরা জড়িত। এটি অত্যন্ত দুঃখের এবং ভয়াবহ। বাংলাদেশে হিন্দুদের প্রতিমা ভাংচুর যেমন হয়েছে পাশাপাশি হিন্দুদের জমি জোড় করে দখল করে নিয়েছে স্থানিয় চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সরকারি দলের ক্যাডারেরা। বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানের গবেষকেরা দেখেছেন, ১৯৮৯ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে ৫ হাজার হিন্দু দেশত্যাগ করেছেন; তাঁদের ৮৯ শতাংশ এসেছেন ভারতে। অন্যদিকে ২০০৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ১ হাজার ৯৩৭ জন বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন; তাঁদের ৩১ শতাংশ এসেছেন ভারতে, ৪৫ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি ২৪ শতাংশ গেছেন ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে। অন্যদিকে ১৯৮৯ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ২০ হাজার ১৭৫ জন মুসলমান দেশ ছেড়েছেন। তাঁদের ৬২ শতাংশের বেশি গিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে।