দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের শিমোগা জেলার মাত্তুর গ্রামের নাম অনেকেই শোনেননি। তুঙ্গা নদীর তীরের এই গ্রাম দেশের অন্য যে কোনো গ্রামেরর থেকেই আলাদা। ব্যাঙ্গালোর থেকে প্রায় ৩০০ কিমি বা ১৮৬ মাইল দূরে এই গ্রামের দোকানদার থেকে খেতমজুর সংস্কৃতে কথা বলেন। কেবল তাই নয়, অধিকাংশ শিশুও সাবলীল ভাবে সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে।প্রাচীন ভারতে যে ভাষাটি পণ্ডিতদের ব্যবহৃত প্রধান ভাষা ছিল, যে ভাষাকে দেবতাদের ভাষা বলে দেবভাষা বলে অভিহিত করা হত। কিন্তু কালের পরিবর্তনে এক শতাংশেরও কম ভারতীয়রা এই ভাষা আজ জানে বা বোঝে, কেবলমাত্র হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই এই ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ হয়। গত শতকের আটের দশকের গোড়ায় মাত্তুরের গ্রামবাসীরা তাঁদের রাজ্যের আঞ্চলিক ভাষা, কন্নড়, পাশাপাশি তামিল ভাষায় কথা বলত। কারণ অধিকাংশ শ্রমিক প্রতিবেশী রাজ্য তামিলনাড়ু থেকে প্রায় শতাব্দী কাল আগে এখানে বসতি স্থাপন করেছিল। তখন সংস্কৃত ভাষার পক্ষে একটি আন্দোলন হয়। সংস্কৃতকে উচ্চ বর্ণ বা ব্রাহ্মণদের ভাষা হিসাবে সমালোচিত করা হয় এবং কন্নড় ভাষা থেকে সরে যাওয়া হয় বলে অনেকেই মনে করেন।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে রোজকার জীবনে সংস্কৃত ভাষা, আচার-ব্যবহারের প্রয়োগ মোটেই সহজ নয়। এর শিকড় খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে ১৯৮১ সালে। সংস্কৃত ভারতী নামে একটি সংস্থা এই গ্রামে ১০ দিনের একটি কর্মশালা করেছিল। সংস্কৃতের প্রচলনই ছিল এই সংস্থার উদ্দেশ্যে। উল্লেখ্য, আগে মাত্তুরের মূলত সাঙ্কেথিরাই থাকতেন। তাঁরা সাঙ্কেথি ভাষাতেই কথা বলতেন। ৬০০ বছর আগে কেরালা থেকে প্রাচীন ব্রাক্ষ্মণ সমাজ এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। তাঁরাই সাঙ্কেথি বলে পরিচিত। সংস্কৃত, তামিল, কন্নড়, তেলুগু এই তিন ভাষা মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলতেন তাঁরা। সেটাকেই সাঙ্কেথি বলা হত। এও বলা প্রয়োজন যে আগে মাত্তুরে মূলত সাঙ্কেথিরাই থাকতেন। তাঁরা সাঙ্কেথি ভাষাতেই কথা বলতেন। ৬০০ বছর আগে কেরালা থেকে প্রাচীন ব্রাক্ষ্মণ সমাজ এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। তাঁরাই সাঙ্কেথি বলে পরিচিত। সংস্কৃত, তামিল, কন্নড়, তেলুগু এই তিন ভাষা মিলিয়ে মিশিয়ে কথা বলতেন তাঁরা। সেটাকেই সাঙ্কেথি বলা হত।
কিন্তু ১০ দিনের ওই কর্মশালা গ্রামের চিন্তাধারা সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। সংস্কৃতের প্রতি গ্রামবাসীদের কতটা আগ্রহ ছিল, তা ওই ওয়ার্কশপেই প্রকাশ পেয়েছিল। দলে দলে ওয়ার্কশপে যোগ দিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। সেই থেকেই শুদ্ধ সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ওই গ্রামে। ১০ দিনের এই ওয়ার্কশপই মাত্তুর গ্রামের চিন্তাধারা সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। সংস্কৃতের প্রতি গ্রামবাসীদের কতটা আগ্রহ ছিল, তা ওই কর্মশালাতেই প্রকাশ পেয়েছিল। দলে দলে কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলেন গ্রামবাসীরা। সেই থেকেই শুদ্ধ সংস্কৃত ভাষার প্রচলন ওই গ্রামে। কিন্তু বলা দরকার যে এই গ্রামের বাসীন্দারা অন্য কোনও ভাষা শেখেন না। দৈনন্দিন জীবনে সংস্কৃতকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন তাঁরা ঠিকই কিন্তু পাশাপাশি ইংরাজি, কন্নড়ের মতো প্রয়োজনীয় সব ভাষাতেই সমান পারদর্শী তাঁরা। তবে হ্যাঁ প্রথম ভাষা হিসাবে সংস্কৃত, দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজি এবং কন্নড় বা তামিল বা অন্য কোনও আঞ্চলিক ভাষা তাদের তৃতীয় ভাষা হিসাবে অধ্যয়ন করে। সংস্কৃত ভাষা ধ্যান জ্ঞান হলেও গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই খোঁজ করলে মিলবে একজন আইটি কর্মী।
ঘটনা হল আধুনিক যুগে সংস্কৃত হল এক ক্ষয়ে যাওয়া ভাষা৷ তার অস্তিত্ব কেবলমাত্র বৈদিক মন্ত্রে, স্তোত্রে কিংবা পুজো, বিয়ে, শ্রাদ্ধশান্তিতে৷ যে অস্তিত্ব আসলে থেকেও নেই, কিংবা না থেকেও আছে! কারণ, যে সংস্কৃত অধিকাংশ ভারতীয় ভাষার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাকে জানা ও বোঝার লোক আজ বিলুপ্তপ্রায়৷ মুখস্থ বিদ্যাই সংস্কৃতের কপাল অথচ, এককালে এদেশে সংস্কৃত টোল থেকেই শুরু হত শিক্ষা গ্রহণ৷ কোনো রাজ্যে হয়ত যার কয়েকটি কোনওমতে টিকে আছে৷ কলেজ স্ট্রিটের ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্মৃতিধন্য সংস্কৃত কলেজও পড়ুয়ার অভাব৷ তবুও স্বমহিমায় সংস্কৃত টিকে আছে দক্ষিণ ভারতের এক প্রান্তিক গ্রাম মাত্তুরে তা কেবল শুধু ভারতীয় ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভিত্তিভূমি হয়ে নয়, এই ইন্টারনেটের যুগে ভারতের একটি আস্ত গ্রামের মুখের ভাষা সংস্কৃত৷ যখন বাঙালি ভুল বাংলা ও ঠিক ইংরেজি বলে খুশি হয় অথবা মনে মনে গর্ব অনুভব করে৷ গড় ভারতীয় যখন সহজে বিদেশি ভাষায় কথা বলে শ্লাঘা বোধ করে, তখন মাত্তুরে কেউ এলে তাকে শুনতে হয়, কথম অস্তি অর্থাৎ কখন এসেছেন? গ্রামের মানুষটি চলে যাওয়ার আগে বলে যান, অহম গচ্ছামি অর্থাৎ আমি যাচ্ছি৷ শুভেচ্ছা কামনায় বলেন, শুভম ভবতু৷