১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পাক শাসক আইয়ুব খান ১৯৬৮ সালে শত্রু সম্পত্তি নামের একটি আইন পাশ করে। ওই আইনি ব্যবস্থার ফলে রাতারাতি সে দেশের হিন্দুদের সম্পত্তি হয়ে যায় শত্রু সম্পত্তি। ওই সময় থেকেই শত্রু সম্পত্তি হিসেবে জবরদখল করে নেওয়া সম্পত্তি আর হিন্দুদেরকে ফেরত দেওয়া হয় না। ফলে তখন থেকেই শুরু হয় হিন্দুদের নিরাপত্তাহীন জীবনযাপন। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ‘শত্রু সম্পত্তির’ নাম পরিবর্তন করে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ রাখা হয়। ফের ২০০১ সালে ‘অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০০১’ প্রণয়ন করা হয়। আসলে যা নতুন বোতলে পুরনো মদের মতো। একটি দেশের আইন কীভাবে হিন্দু নাগরিকের জীবন সংকুচিত এবং দুর্বিসহ করে দিতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল শত্রু সম্পত্তি তথা অর্পিত সম্পত্তি আইন। রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, বাংলাদেশ সরকারের অবসর প্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব ২০০৭; ২৯ মে, ‘এশিয়ান ট্রিবিউন’-এ লেখেন, “২০০১ সালে আওয়ামীলীগ অর্পিত সম্পত্তি আইন রদ করে হিন্দুদের সম্পত্তি হিন্দুদের ফিরিয়ে দিতে ওই আইন প্রণয়ন করে ঠিকই কিন্তু সেটা ছিল নেহাত একটা রাজনৈতিক খেলা এবং ভোটের চালাকি। লোক দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা। অর্পিত সম্পত্তি বেশীরভাগই তখন পর্যন্ত ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের দখলে। ফলে আইনি জটিলতায় সেই সম্পত্তি আর আসল মালিকের কাছে হস্তান্তর সম্ভব হয় নি। প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ হিন্দু পরিবার শত্রু বা অর্পিত সম্পত্তি আইনের শিকার হয়, প্রায় ২০ লাখ একর ভূসম্পত্তি হারায়। স্বাধীন বাংলাদেশে সব সরকারের আমলেই হিন্দুদের ভূসম্পত্তি জবরদখল হয়েছে তবে ২০০১-এ বিএনপি সরকারের আমলে তা মাত্রা ছাড়ায়”। পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসে বিএনপি-র দমন নিপীড়নের বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে হিন্দুদের কিছুটা আশার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তেমন ফলপ্রসূ বা কার্যকর পদক্ষেপ করা হয় না।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের পোষা বাংলাদেশী দোসর আলবদর, রাজাকার এবং আল শামস নামক বাহিনীর অত্যাচারের টার্গেট ছিল হিন্দুরা। কারণ, তাদের অত্যাচার, ধর্ষণ ইত্যাদি চলত প্রধানত বেছে বেছে বাংলাদেশের হিন্দু এলাকা গুলিতে। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির আগেও পাকিস্তান সরকার হিন্দুদের অত্যাচার করেছে কিন্তু তা নতুন রাষ্ট্রে যে মাত্রা পায় তাকে অতিক্রম করতে পারেনি। পাক ভারত যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ তুলতে পাকিস্তানিরা পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের সম্পত্তিকে শত্রু সম্পত্তি বলে ঘোষণা করেছিল। তবে একথা ঠিক মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু মুসলমান সবাই আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু হিন্দু হলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাত থেকে কেউ কখনও নিষ্কৃতি পেত না। পাকিস্তানি হানাদাররা বেশিরভাগ সময়েই প্রথমে আক্রমন করত হিন্দু অধ্যষুত এলাকাতে। পুরুষদের লুঙ্গি খুলে লিঙ্গ নির্নয় করত; খাতনা করা থাকলে মুসলমান বলে কিছুটা রক্ষা আর খাতনা না থাকলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি। অনেক সময় কালেমা পড়িয়ে পরিক্ষা চলত, জে কারণে অনেক হিন্দু কলেমা শিখতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাতে যে জীবন রক্ষা হয়েছে তাও নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ভারতের প্রত্যক্ষ সাহায্যে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং পাক কারাগারে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে পরিত্রান পাওয়া স্বত্বেও শত্রু সম্পত্তি আইনটি নিষিদ্ধ না করে কেবলমাত্র নাম ‘অর্পিত সম্পত্তি’ দিয়ে হিন্দুদের সহায় সম্পদ বঞ্চিত করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছিলেন। ইচ্ছাকৃত না হলেও তা হয়ত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কিংবা তাঁর শত্রু শিবিরের চাপে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পরে যারা বাংলাদেশে ক্ষমতায় এসেছিল তারা সবাই পাকিস্তানি দোসর। নতুন রাষ্ট্রের মুলনীতি পাল্টে তারা পাকিস্তানী ভাবধারায় রাস্ট্র পরিচালনা করতে লাগল। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠন। কিন্তু পাকিস্তানী খুনিচক্র ধর্মকে বর্ম বানিয়ে কেউ সংবিধানে বিসমিল্লাহ্ যোগ করল কেউ বাংলাদেশের নামকরন করল ইসলামি রিপাব্লিক বাংলাদেশ। বোকা ধার্মিকদের আর ধর্মভিরুদের খুশি করে ক্ষমতা টিকেয়ে রাখতে যারা এটা করেছিল তাদের শাসন কালে যে হিন্দুরা নির্যাতিত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। একটানা সামরিক স্বৈরশাসন চলে দীর্ঘ ৯ বছর। এরপর ১৯৯১ সালের সাধারন নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি, কিন্তু নতুন ভাবে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নির্যাতন শুরু হয়। হিন্দুরা আওয়ামিলীগ তথা নৌকায় ভোট দেওয়ায় অনেককে হত্যাকরা করা হয়, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং ধর্ষন করা হল সংখ্যালঘু হিন্দু তরুণীদের। এইসব ঘটনার প্রত্যেকটিতে যুক্ত ছিল বিএনপির ক্যাডারেরা। আতঙ্কে অনেক হিন্দু বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হল। নির্যাতনের সেই আগুন্রে জ্বলে ওঠে বাবরি মসজিদ ভাঙাকে কেন্দ্র করে। হিন্দুদের উপর নির্যাতন তো আছেই তার সঙ্গে মন্দিরে আগুন ও ভাঙচুর চলতে থাকে। কিছুটা হলেও বাংলাদেশের হিন্দুরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল ১৯৯৬ সালের সাধারন নির্বাচনে আওয়ামিলীগ ক্ষমতা আসার পর। বলা যেতে পারে হিন্দুরা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এই ৫ বছর জায়গা জমি সংক্রান্ত দু-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া হিন্দুদের উপর বড় কোনো আক্রমণের খবর পাওয়া যায়নি।
(চলবে)